গ্রাম কি বাঁচবে

এক সময় বলা হতো, আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। এখন বলা হচ্ছে, না গ্রামই থাকবে না। সব গ্রাম শহর হয়ে যাবে অর্থাৎ গ্রামের চিহ্ন মুছে ফেলা হবে। গ্রাম শহরে রূপান্তরিত হবে। শহর বাড়তে বাড়তে গ্রাম দখল করবে, না খোদ গ্রামকে শহর বানিয়ে দেওয়া হবে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বিষয়টি যদি এরকম হয়- গ্রাম গ্রামই থাকবে, এখানে পৌঁছে দেওয়া হবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তাহলে আপত্তির তেমন কারণ থাকে না।

পুরোপুরি শহর না হলেও গ্রাম যে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে একথা কিন্তু মিথ্যে নয়। ফসলি জমি, পুকুর, খাল-বিল, নদ-নদী ইত্যাদি বিভিন্ন জলাশয় ভরাট করে ঘরবাড়ি, বিপণি বিতানসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। বালির পাহাড়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে তিন ফসলি জমিগুলো। একদা যেখানে সারাবছর ধান-পাট আর বিভিন্ন শাক-সবজির আবাদ হতো সেসব জমিতে এখন তিনতলা-পাঁচতলা-দশতলা দালান। গড়ে উঠছে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা বা মার্কেট। প্রতিদিন কমছে জমি, বাড়ছে মানুষ। 

যেসব স্থাপনা হচ্ছে- এর বেশিরভাগই জবরদখল, স্বল্পমূল্যে কিনে বা সরকারি খাস জমি, জলাশয় দখল করে করা হচ্ছে। আমাদের একজন বিশিষ্ট সচেতন নাগরিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আবুল মকসুদ সম্প্রতি এক লেখায় (‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সংখ্যা) বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সবচে’ বেশি নির্যাতিত নদী ও নারী।’ তিনি ‘নদী কমিশন’-এর বরাত দিয়ে বলছেন, দেশে ৪২ হাজার ৩২০টি নদী বেদখল হয়ে গেছে। এটি সরকারি পরিসংখ্যান। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। যে দেশে ৫০ হাজার নদী বেহাত হয়ে যায়, সেদেশে কত খাল-বিল-নালা-পুকুর-দীঘি বেদখল হয়ে গেছে, তা সহজেই অনুমেয়। 

জীবিকার তাগিদে আমাদের দেশে নদীর পাড়ে পাড়ে একসময় গ্রাম আর বাজার-বন্দর গড়ে উঠেছিল। নদী হারিয়ে যাওয়ায় নদীতীরের মানুষরাও নিঃস্ব হয়েছেন। তারা পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের বাড়িঘর বেদখল হওয়ায় তারা দেশান্তরী হয়েছেন বাধ্য হয়ে কিংবা হয়েছেন শহরমুখো। দেশের বড় বড় শহরগুলোতে আজ যে এত ছিন্নমূল মানুষ দেখা যায়, তারা তো সব গ্রাম থেকেই নিরুপায় হয়ে চলে এসেছেন। হয় ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন প্রাকৃতিক কারণে, নয়তো মানুষের অত্যাচারে। 

এখন যদি সরকারিভাবে বলা হয় গ্রাম থাকবে না, সব শহর হয়ে যাবে, তাহলে যেসব ভূমিদস্যু নদ-নদী, খাল-বিল, কৃষিজমি, বসতবাড়ি দখল করেছে, তারা তো আরো উৎসাহিত হবে। তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রাম রেখে কী হবে? শহর বানাও। গ্রাম মানুষের কোনো কাজে আসে না। তাদের বোঝানো হচ্ছে, সুইচ টিপলেই যাতে নাগরিক সুবিধা অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কাউকেই কোনো পরিশ্রম করতে হবে না। শুয়ে শুয়ে সুইচ টিপলেই সব পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ ‘সব পেয়েছিল দেশ’ হয়ে যাবে। 

তাহলে কি আমাদের গ্রামের কোনো প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। গ্রাম আমাদের বাঁচার প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করে। মানুষই যদি না বাঁচে, তাহলে আমরা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কী করব? মানুষ ‘প্রকৃতির সন্তান’। অন্যভাবে বলা যায় মানুষ প্রকৃতির অংশ। গ্রাম মানেই প্রকৃতি। এখানে নদী আছে, পুকুর আছে, সবুজ গাছপালা আছে, শষ্যক্ষেত আছে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব দরকার। এগুলো বানানো কথা না। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথা। 

মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য, পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য, ফসল ফলানোর জন্য বৃষ্টির দরকার হয়। গাছ-গাছালি বনজঙ্গল না থাকলে বৃষ্টি হয় না। ফসলের পরিমাণ কমে যায়। পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয়। বাংলাদেশে যার আলামত অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। দেশে ২৫ ভাগ বনজঙ্গল রাখার কথা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেন। এখন বাংলাদেশে যা ৫ শতাংশেরও কম। গ্রাম যদি হারিয়ে যায়, তাহলে পরিবেশ-বিপর্যয় আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। আমাদের জীবন এখনি হুমকির সম্মুখীন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই বিপর্যয়ের জন্য একদিন হারিয়েও যেতে পারে। সমুদ্রগর্ভে বিলীন কিংবা ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এগুলো কোনো গালগল্প নয়, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বার বার আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করছেন। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এ বিষয়ে নির্বিকার। অতএব, নিজেদের বাঁচার স্বার্থে আমাদের গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের এখনকার স্লোগান হওয়া উচিত ‘গ্রাম বাঁচলে সবাই বাঁচব, নতুবা হারিয়ে যাব।’ 

নগর সভ্যতার ভয়াল রূপ দেখে একদা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ নগরায়ণের বিপক্ষে ছিলেন? তা কিন্তু নয়। রবীন্দ্রনাথ নগরায়ণের বিপক্ষে যেমন ছিলেন না, আমরাও কিন্তু এর বিপক্ষে না। নগরায়ণ যা হওয়ার হয়ে গেছে। তা ভেঙে আর গ্রাম করা যাবে না। আমাদের কথা হলো নগর ও গ্রাম দুটোই থাকবে। তবে নগর হবে পরিকল্পিত। আর গ্রাম থাকবে গ্রামের মতো। এখানে যোগ হবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। যেমন- গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল। গ্রামকে ইট-কাঠের জঙ্গল বানালে এখানে সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। পরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি পরিকল্পিত গ্রামায়ণ করতে হবে। এর স্বরূপ হবে- গ্রাম থাকবে, গ্রামের নদী থাকবে। পুকুর-জলাশয়, খাল-বিল সবকিছু থাকবে। আর ভরাট করে কমানো যাবে না। তাহলেই গ্রাম বাঁচবে। সবকিছুই আগের মতো থাকতে হবে। গ্রাম বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে। প্রকৃতি বাঁচলে প্রকৃতির সন্তান মানুষও বাঁচবে। 

তবে এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যা রাষ্ট্রের এখতিয়ার। রাষ্ট্রচিন্তা পরিবেশবান্ধব না হলে তা কিছুতেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের সহযোগিতা ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচানো যাবে না। সর্বাগ্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশচিন্তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: হিমাদ্রিশেখর সরকার
প্রাবন্ধিক, ছোট গল্পকার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //