হিন্দুত্ববাদের সম্প্রসারণ: সংকটে দক্ষিণ এশিয়া

ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে জাতিবর্ণের আর্থ-সামাজিক বৈরিতা বহুকালের। সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতি-সহাবস্থানের ইতিহাসও হাজার বছরের। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের চিন্তা, চর্চা ও বিশ্বাসের বৈচিত্র্যকে পুঁজি করে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়ে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিস্ফোরণ ঘটে। তারই ফলাফল জালিয়ান ওয়ালাবাগ, পশ্চিমবঙ্গসহ বহু স্থানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর পরবর্তীকালে দেশভাগ। 

দেশভাগের বিশ্লেষণে আজও চলছে দোষারোপের রাজনীতি। হিন্দুর অভিযোগ মুসলমানের বিরুদ্ধে, আর মুসলমানের অভিযোগ হিন্দুর বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে অনিঃশেষ ঘৃণার চর্চা অব্যাহত রয়েছে সাত দশক ধরে। কিন্তু আসল বাস্তবতা হলো- দেশভাগে শুধু দেশই ভাগ হয়নি। ভাগ হয়েছে মানুষ, পরিবার সবকিছু। ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে, কিন্তু এখনো পাকিস্তান, ভারত কিংবা বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বৈরিতার অবসান হয়নি। 

বহু বিশ্লেষক বলেন, পাকিস্তান আন্দোলন ছিল ‘পাগলামি’। সে আলাদা বিতর্ক। কিন্তু পাকিস্তানের বাইরে যে ভারত অবশিষ্ট ছিল তার প্রতি আস্থা রেখেছিল অধিকাংশই। মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসা’ আর নেহরুর ‘বহুত্ববাদ’ সমন্বিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন এক ভারতের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। শুরু থেকেই তার মাঝে হিন্দু মৌলবাদের চেহারা উন্মোচিত হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে মহাত্মা গান্ধীকেও। তবু মনে করা হতো ভারত এখনো উদারপন্থীদের হাতেই রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের রাজনৈতিক শাখা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্পষ্ট হয়ে পড়ছে- অসাম্প্রদায়িক আর সেক্যুলার ভারত তার বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপ নিচ্ছে। 

ভারতজুড়ে এই সংকটের পেছনে তিনটি কারণ বিদ্যমান
এক. শুরু থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে অসাম্প্রদায়িক ও সেক্যুলার ভারতের প্রতিনিধি ধরা হলেও, সেখানেও লুকিয়ে ছিল নানা ধরনের হিন্দুত্ববাদী ভূত। দেশভাগের সময় থেকে কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা তার বড় প্রমাণ। এছাড়া নেহরু থেকে রাহুল গান্ধী পর্যন্ত বহু কংগ্রেস নেতা পাকিস্তান বিরোধিতা করতে গিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে একই ভাষায় কথা বলেছেন। কংগ্রেস শুরু থেকেই সেক্যুলার ও সর্বজনীন ভারতের কথা বলে আসলেও নীতিগতভাবে উন্নয়নের নামে অভিজাত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে- সেটাও বৈষম্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আখেরে দরিদ্র শ্রেণিকে আরও বেশি হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে।

দুই. রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী না হলেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো বহু আগে থেকেই সক্রিয় ছিল ভারতে। ১৯২৩ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকার ‘হিন্দুত্বের’ রাজনৈতিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তাতে ‘অ-হিন্দু’দের অ-ভারতীয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই দর্শনের অনুসারীরাই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে ‘মহাভারত’ গঠনের স্বপ্ন দেখে। তারাই মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নথুরাম গডসেকে ভারতের ‘জাতীয় বীর’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। এই দর্শনের অনুসারীরা আজ শুধু ভারত নয়, বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। তারাই গত কয়েক দশকে দরিদ্র হিন্দু যুবকদের গরু রক্ষার নামে সহিংসতার জন্য ‘বজরঙ্গ দল’ সংঘবদ্ধ করেছে। 

তিন. এই ‘হিন্দুত্ববাদ’ তার মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে যে মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করেছে, সেই সম্প্রদায়টি নানা প্রকারে ভারতীয় সাধারণের কাছে প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে। শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা একসময় জয় করেছিল লাঞ্ছিত-বঞ্চিত নমঃশূদ্র ও দলিত সমাজের হৃদয়কে, তারা আজ পরিচয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত, বহুধা বিভক্ত হয়ে নিজেরাই হয়ে পড়েছেন কোথাও ‘অদৃশ্য নাগরিক’ আবার কোথাও ‘বিদেশি’। আর এ সবের সমন্বিত ফলাফল হলো- গত ১০ বছরে ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পরিমাণ ২৮ শতাংশ বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা। 

উল্লেখ করা যায়, রাজতন্ত্র চলাকালে নেপাল সাংবিধানিকভাবে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০০৮ সালে গণতন্ত্র চালুর পর নানা রাজনৈতিক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দেশটি একটি ‘গণতান্ত্রিক’ সংবিধান গ্রহণ করে ২০১৫ সালে। ২০০৮ সালের পর থেকেই দেশটিতে গণতন্ত্রায়নের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাধান্য পাচ্ছিল। তার বিপরীতে ভারতের বিজেপির আদলে নেপালে জনতা পার্টি গঠন করা হয়। ওই দলের প্রধান এজেন্ডা হচ্ছে নেপালকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এবং ভারতের বিজেপি এবং তার আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠান আরএসএস প্রকাশ্যে এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে বিজেপির লোকসভা সদস্য সুব্রমনিয়াম স্বামী কাঠমান্ডুতে এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্রের পরিচয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।’  

আরএসএসের এই সম্প্রসারণ নেপালেই শুধু নয়, বাংলাদেশেও হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশের অভিজ্ঞতা থেকে একথা স্বীকার করা যৌক্তিক যে, বাংলাদেশেও মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রভাব বিস্তারের মানসিকতা ছিল, আছেও। এর প্রতিরোধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বরাবরই মানবিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, অসাম্প্রদায়িক প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিবাদ করে আসছিল। সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের এসব উদ্যোগের সঙ্গে সচেতন ও দায়িত্বশীল মুসলিম পরিচয়ের ব্যক্তিবর্গও যুক্ত থাকতেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িক প্রবণতার বিপরীতে আরেকটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিকাশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ঘৃণার বিস্তার ঘটছে। 

গত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদলে বাংলাদেশেও বাংলাদেশ জনতা পার্টি (বিজেপি) নামে একটি রাজনৈতিক দলও আত্মপ্রকাশ করেছে, যারা বিজেপির প্রতীক ও কর্মসূচির অনুসরণ করছে। বলে রাখা দরকার যে, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা যে কারো সাংবিধানিক অধিকার; তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু একটি দল কী ধরনের মতাদর্শ ধারণ করছে, তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আছে। কেননা যে কোনো সাম্প্রদায়িক আদর্শ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে সম্প্রীতির বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে পারে। 

হিন্দুত্ববাদের সম্প্রসারণশীল অবস্থার স্বরূপ আলোচনা করতে গেলে আরও কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, যা এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একাধিক গবেষণামূলক নিবন্ধে এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এর মধ্যে ইনগ্রিড দেয়ারওয়াথ ‘সাইবার হিন্দুত্ব’ নিয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৮০-এর দশকে বিজেপি ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সময়কাল থেকেই ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক হিন্দু দক্ষ কর্মশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় এবং তারা ধীরে ধীরে হিন্দুত্বকে একটি বৈশি^ক নেটওয়ার্কে রূপ দেয়। ইতিহাসের এক সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারণা ছিল- ভারত মহাসাগরের (কালাপানি) সীমানা অতিক্রম করলে ব্রাহ্মণ বর্ণ হারিয়ে যাবে। কিন্তু নতুন শতকে এসে তারাই এক বিশ্বায়িত হিন্দুত্ববাদের ধারণা নিয়ে এসেছে।’

নিউ ইয়র্কভিত্তিক ভারতীয় অধিকার কর্মী সুনিতা বিশ^নাথ এক সক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে এসব হিন্দুত্ববাদী গ্রুপের বিপরীতে কিছু প্রগতিশীল হিন্দু ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, যারা ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিপরীতে হিন্দু ধর্মের মূল শিক্ষা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি তারা ভারতে নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও অ-হিন্দু নাগরিকদের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। এসব ব্যক্তিও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সময়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলোর হাতে।’ 

হিন্দুত্ববাদের এই অনুসারীরা প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের পূর্ণ ব্যবহার করে আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাবশালী অবস্থান সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে ৯/১১-এর পরবর্তীকালে ইউরোপ-আমেরিকার নেতৃত্বে বিকশিত হওয়া ইসলামোফোবিয়া, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের সঙ্গেও নিজেদেরকে যুক্ত করে হিন্দুত্ববাদের অনুসারীরা। কেননা শুরু থেকেই হিন্দুত্ববাদের মধ্যে সন্বিবেশিত ছিল মুসলিম বিদ্বেষ। দৃশ্যত এ কারণেই ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার পর নরেন্দ্র মোদিকে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ নিষিদ্ধ করলেও পরে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়। কাজেই হিন্দুত্ববাদকে শুধু হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। হিন্দুত্ববাদ একটি বৈশি^ক কাঠামোর মধ্যে থেকেই ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি করে চলছে। ভারত ও পার্শ^বর্তী দেশগুলোতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য সৃষ্টি হওয়া ঝুঁকি মোকাবেলায় এসব বিষয়ে সমন্বয় করেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। 

বলে রাখা দরকার, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পাল্টা একটা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জোয়ার তুলে একে মোকাবেলা করা যাবে না। সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সহাবস্থানের যেসব উপাদান বিদ্যমান সেগুলোকে বিকশিত করতে হবে। সেই সঙ্গে পরিষ্কার করতে হবে যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বন আর হিন্দুত্ববাদী দর্শন এক নয়। হিন্দুত্ববাদকে দায়ী করতে গিয়ে হিন্দু ধর্মকে দায়ী করার চেষ্টা সবার আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিদ্বেষের প্রতিক্রিয়ায় যাতে সংখ্যালঘু অমুসলিমরা আক্রান্ত না হয়, সে বিষয়ে ভূমিকা নিতে হবে। হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসী বয়ানের বিপরীতে হিন্দু ধর্মের ‘অহিংসা’, ‘ভক্তি’ ও ‘ভালোবাসা’র নীতির ভিত্তিতে বিপরীত বয়ান তৈরি করতে হবে। এ কাজে হিন্দু ধর্মীবলম্বী ব্যক্তিদেরও অংশীদার করতে হবে। সর্বোপরি সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে মানবিকতার রাজনীতি বিকশিত করার জন্য চেষ্টা চালানোর কোনো বিকল্প নেই।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //