ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে

হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর পথ অনূকরণীয়

মশা মারতে কামান দাগানোর প্রচলিত কথাটিই এখন বাস্তবতা। তবুও মশাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। আর তাই চলতি বছর চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা প্রায় মহামারি আকারে দেখতে হচ্ছে আমাদের, যা এখন ঢাকা মহানগরী ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। অর্ধশতেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই এডিস মশা। তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারেও থাবা বসিয়েছে এই মশা। তবে দুঃখজনক হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মশক নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব ঢাকা মহানগরীর দুটি পৌর তথা সিটি করপোরেশনের ওপর অর্পণ করেই ক্ষান্ত থেকেছে। প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন না করে নিরাপদ দূরত্বে থেকে শুধু পর্যবেক্ষণ আর মাঝে-মধ্যে আশার বাণী দিয়ে মিডিয়াতে বিবৃতি দিয়ে কাজ শেষ করেছে; কিন্তু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়টি কেমন করে আর কার স্বার্থে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চলে গেল এটাও বোধগম্য নয়। 

ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন দীর্ঘদিন ধরে বিপুল অর্থ ব্যয়ে অকার্যকর মশা নিধনের ভেজাল ওষুধ এনে ফগার মেশিনে ধোঁয়া সৃষ্টি করে নাগরিকদের সঙ্গে কেবল প্রতারণাই করে গেছে। সরবরাহকারী ও আমদানির অনাপত্তিপত্র প্রদানকারী ব্যক্তিদের কাউকে শনাক্ত করে, জনগণের অর্থ অপচয়ে বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব; কিন্তু সরকার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে জনদুর্ভোগ বাড়াতে প্রকারান্তরে সহযোগিতা করেছে বলে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। উপরন্তু হাস্যকরভাবে একজন মেয়র বলে বসেছেন মশাগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠায় ওষুধে মারা যাচ্ছে না। আবার কেউ আবহাওয়াকে দায়ী করেও নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে চেয়েছেন। ২০১৮ সালে আইসিডিডিআরবি মশার ওষুধ পরীক্ষা করে অকার্যকর বলার পর, অন্য একটি ল্যাবে পরীক্ষা করে একই ফল পাওয়া গেলেও সরবরাহকারীর স্বার্থ রক্ষায় সিটি করপোরেশন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কোনোরকম ল্যাব টেস্ট ছাড়াই একটি মাত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অকার্যকর মশার ওষুধ ক্রয়ের অন্তরালে নিশ্চিতভাবেই দুর্নীতি হয়েছে; কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রী ও দায়িত্বশীলরা সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ না করে একের পর এক মনগড়া মন্তব্য করায় মানুষের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

এ বছর ডেঙ্গু রোগ ও মৃত্যুর সংখ্যা বিগত সব বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। হবিগঞ্জের সিভিল সার্জনসহ কয়েকজন চিকিৎসকও ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। কার্যকর ওষুধ আমদানি সময়ের মাঝখানে প্রয়োজন বিধায় দক্ষিণের মেয়র উচ্চ আদালতের খড়গ এড়াতে বিনামূল্যে স্কুল-কলেজ ও বড় স্থাপনায় অ্যারোসল স্প্রে বিতরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এরকম খবর পাওয়া যায়নি। বরং নাগরিকদের নিজেদের স্বার্থে প্রত্যেককে সচেতন হওয়ার আহ্বানকে জোরালোভাবে প্রচার করা হয়েছে। আর এর মধ্যেই দেশের প্রায় সব জেলাতে মরণব্যাধি ‘ডেঙ্গু’ ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আফ্রিকার ইবোলা ভাইরাসের মতো এদেশকে অনেক মাসুল দেওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোনো অঘটন বা সমস্যায় ষড়যন্ত্র আবিষ্কার না করে সমস্যার উৎস খুঁজে সমাধানের উদ্যোগই প্রশংসনীয় হতে পারে।

একজন হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর কথা হয়তো এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তৎকালীন নোয়াখালী তথা এখনকার ফেনী জেলায় ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণকারী প্রয়াত হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী পাকিস্তান আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনসহ ক্রীড়া ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয় থাকায় ফেনীর পরশুরাম আসন থেকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে মশক নিয়ন্ত্রণের কাজকে পৌরসভা থেকে আলাদা করে মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার বকশীবাজারের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উল্টো দিকের পুকুরপাড়ে (দৈনিক আজাদ পত্রিকার পূর্ব পাশে) মশক নিয়ন্ত্রণের মূল অফিসটি অবস্থিত ছিল। দৈনিক কম-বেশি ১০০-১২৫ জন মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মীর মাধ্যমে সেখান থেকে স্প্রে মেশিন ও জারে করে মশা নিয়ন্ত্রণের তৈলাক্ত ওষুধ সংগ্রহ করে নগরীর প্রতিটি ইউনিয়নে (বর্তমানে ওয়ার্ড) ছিটানো হতো। তৎকালীন ১২-১৫ লাখ মানুষের বসবাসের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা তথা আজকের পুরান ঢাকার অলিগলির নর্দমা আর বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে সপ্তাহে ন্যূনপক্ষে একবার করে ওষুধ দিত। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে মশা উৎপাদন বন্ধে কাজ করত। অনেক সময় বিমানের মাধ্যমে পূর্ব সতর্কতা রেডিওতে প্রচার করে মশার ওষুধও ছিটিয়ে দিত। সেই সময় মশাবাহিত মরণব্যাধির অস্তিত্বও ছিল না। ফলে মশারি ব্যবহারে অনভ্যস্ত পুরান ঢাকায় মানুষ স্বস্তি পেত। আশ্চর্যজনকভাবে প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত    হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী নগরী থেকে মশাতঙ্ক দূর করেছিলেন।

বর্তমানে ডেঙ্গু মশার এই উদ্বেগজনক আক্রমণে প্রয়াত হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর অনুসৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পৃথক মশক নিধন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে সিটি করপোরেশনকে এই ভারমুক্ত করা গেলে সার্বিকভাবে মশক নিধন গতিশীল হতে পারে। জনমনে মশাতঙ্ক দূর করা সিটি করপোরেশন ও তদীয় ওয়ার্ড কমিশনারদের মাধ্যমে অর্থ ব্যয় ছাড়া ইতিবাচক ফল লাভ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিধায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করে, মশা নিয়ন্ত্রণ বা নিধনের জন্য হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর নীতি অনুসরণ করে পৃথক অধিদপ্তর সৃষ্টি করে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে দুই সিটি করপোরেশনে কর্মরত প্রায় ৭০০ স্প্রে ম্যানকে উক্ত অধিদপ্তরে সংযুক্ত করাও সহজতর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৈষ্ণিক আবহাওয়ার পরিবর্তন, নতুন নতুন মরণব্যাধির উন্মেষ এবং জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় এনে এখন থেকেই কার্যকর ও আধুনিক ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। না হলে আগামীতে মশাবাহিত বিভিন্ন মরণব্যাধি মহামারি আকারে দেশকে গ্রাস করতে পারে।

লেখক: আবুল খায়ের
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক
পিএমও

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //