রেল উন্নয়ন ভাবনা

বাংলাদেশ অঞ্চলে রেল পরিবহনের সূচনা হয়েছিল ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার জগতি-দর্শনা সেকশনে ৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এরপর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গড়ে ওঠে ৭১৩ কিলোমিটার রেলপথ। মোট ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার রেলপথ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে গঠিত হয়। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে ২৫৮ কিলোমিটার নতুন রেলপথ যোগ হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রা শুরু করে ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার রেললাইন নিয়ে। ১৯৮৪ সালে দেশে রেলপথ সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২ হাজার ৮৯১ কিলোমিটার। ১৯৯৬ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু রেলপথ তুলে ফেলতে চাইলে তা আবার হ্রাস পায়। প্রকৃতার্থে স্বাধীন বাংলাদেশে রেল পরিবহন যে গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, তার কিছুই পায়নি। বরং শত শত কোটি টাকার লোকসান জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার কার্যক্রম চলছে জোরগতিতে। 

জনগণের জন্য সুলভ এবং নিরাপদ যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের জন্য সামগ্রিকভাবে রেল পরিষেবার উন্নয়নই কাম্য ছিল। ১৯৮৭-৯১ তে ইউএনডিপি এবং এসকাপ-এর যৌথ প্রকাশনায় বলা হয়েছে Challenges: inland water transport has significant economic advantages comparing fuel consumption the tonne-kilometers per liter for inland water ways is 217 compared with only 85 for rail transportation and 25 for a large diesel truck.. স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের পরিকল্পনাবিদরা এ প্রকাশনাকে মূল্যায়ন না করে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পরিবহন ব্যবস্থা সড়ক পথকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছে। ফলে আমাদের পরিকল্পনার সবটাই উলটো হয়ে গিয়েছে। আমরা নৌপথ ধ্বংস করে ফেলেছি আর রেলকে অবজ্ঞা অবহেলা করে চরম সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছি। স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে পরিকল্পনাকারীদের এমন মানসিকতা কাম্য ছিল না।

বাংলাদেশের জনগণের পণ্য পরিবহনের জন্য আমাদের দেশপ্রেমিক পরিকল্পনাবিদরা ২৫ টাকার কাজ ৮৫ টাকা না করে ২১৭ টাকায় করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন। এতে দেশের মানুষ বাস-ট্রাক মালিকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে আর দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে। যা এখন দেশের প্রতিজন মানুষ হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে। কথায় কথায় ধর্মঘট করায় পরিবহন ব্যবস্থাকে কোনো আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশ বললেও আত্মঘাতী কার্যক্রমে নৌপথ অনেক আগেই পরিকল্পনার বাইরে চলে গিয়েছে। ঝামেলামুক্ত, আরামদায়ক, তূলনামূলক নিরাপদ, সুলভ এবং রেলভ্রমণে বিশ্বব্যাপী যাত্রীদের আগ্রহ বেশি হওয়ার পরও আমরা সেপথে হাঁটিনি। উল্টো রেলপথ বৃদ্ধি না করে চলমান ২৩টি শাখা লাইন তুলে দেওয়ার আদেশ জারি করা হলো। রেলের ওয়ার্কশপগুলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হলো না। অভিজ্ঞ জনশক্তিকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় বিদায় করা হলো। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত হর্সপাওয়ারের বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন কেনা হলো। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন চীনের ডেমো ট্রেন আমদানি করে রেলের ঘাড়ে লোকসানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে রেলকে স্বজ্ঞানে জনকল্যাণের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

মহাজোট সরকার যাত্রীসেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে রেলকে একটা শক্তিশালী গণপরিবহন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বহু পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর রেলসেবার উন্নয়নে তিন স্তরে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ৬৭টি কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয় যা ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে সম্পাদনের কথা থাকলেও তার অগ্রগতি সুখকর হয়নি। দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালের এপ্রিলে স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ১২টি পরিকল্পনা ঘোষণা দিয়ে যত্ন করে তুলে রাখা হয়। এ ছাড়া ৫ বছর মেয়াদি নতুন কর্মপরিকল্পনায় ২১টি স্বল্পমেয়াদি যা ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে, মধ্যমেয়াদি ২২টি কার্যক্রম যা ২০১৬ সালের মধ্যে এবং দীর্ঘমেয়াদি ৬টি যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি।

রেল ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন এভাবেই চলমান। স্টেশনে রক্ষণারেক্ষণের অভাব প্রকট। সময়সূচি মোতাবেক রেলসেবা নেই, প্রয়োজনীয় টিকিট পাওয়া যায় না, যাত্রীসেবার মান খুব সীমিত। তারপরও যশোর রেলস্টেশনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ লাখ ৪১ হাজার ৬১৮ যাত্রীর কাছ থেকে আয় হয়েছে ১২ কোটি ৩৯ লাখ ১৪ হাজার ৩৮৫ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৩ জন যাত্রীর কাছ থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৩ টাকা। রেলসেবার সীমিত সুযোগের মধ্যেও যশোর স্টেশনে যাত্রী ও আয় বেড়েই চলেছে। এ চিত্র শুধু যশোরের নয় সারাদেশের। অথচ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেসে যশোরের জন্য সিট বরাদ্দ মাত্র ১৬০ টির মতো, যার ফলে প্রতিদিনই টিকিট না পাওয়ার হতাশা নিয়ে যাত্রীরা ফিরে আসতে বাধ্য হতো। সম্প্রতি যশোরবাসীর আন্দোলনের ফলে অল্প কিছু আসন বৃদ্ধি করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যাত্রীকল্যাণের কথা বিবেচনা করে সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেসে বগি সংযোগ করে সিট বৃদ্ধির উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল; কিন্তু তা করা হলো না। 

আশার কথা সম্প্রতি বেনাপোল এক্সপ্রেস নামে নতুন একটা আন্তঃনগর ট্রেন বেনাপোল-ঢাকা রুটে যাত্রা শুরু হয়েছে। মোটামুটি বিরতিহীন এই ট্রেনটি চালু হওয়ায় এলাকার মানুষ উপকৃত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে যাতায়াত করে, পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের চাপও বিশাল। তাই সরকারের এটা একটা সাধু উদ্যোগ। কিন্তু  আমরা জানি না আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কতদিন এই আন্তঃনগর ট্রেনটির চরিত্র ঠিক রাখবেন? তবে জনগণের শ্রমঘন্টার কথা বিবেচনায় রেখে সরকার ও কর্তৃপক্ষ ট্রেনটির চরিত্র আজকের মতো বিরতিহীন রাখতে সচেষ্ট থাকলে, মানুষ বেশি উপকৃত হবে। নতুন ট্রেনটি চালু হওয়ার ফলে যশোরের জনগণের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ সমস্যা আপাতত কিছুটা সমাধান হলো। এতে নতুন একটা বিষয় সামনে এসেছে, খুলনা-ঢাকা বিরতিহীন ট্রেন চালুর। এলাকার মানুষ আশা করে সরকার জনকল্যাণের বিষয়টি ভাববে এবং অবিলম্বে উদ্যোগী হবে।

মহাজোট সরকার সারাদেশে নতুন নতুন রেলসেবা সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিচ্ছে। আন্তঃনগর বিরতিহীন ট্রেনের পাশাপাশি ছোট ছোট রুটের রেল পরিষেবা বৃদ্ধি প্রয়োজন। যেমন বিভাগীয় সদর খুলনা হওয়ায় প্রতিদিন শত শত যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যশোর থেকে সড়কপথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে। সময়সূচিতে সমন্বয় না হওয়ার কারণে দিনের কাজ দিনে সম্পন্ন করে ঘরে ফেরার কোনো রেলসেবা যশোরবাসী পায় না। তাই জনকল্যাণে সুলভ ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে উভয় দিকের অফিস যাত্রীদের জন্য যশোর-খুলনা কমিউটার ট্রেন চালু করা হলে মানুষ প্রকৃত অর্থেই উপকৃত হতো। আমাদের নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। 

মহাজোট সরকারের রেলসেবা বৃদ্ধির উদ্যোগ চলমান রাখতে রেললাইনের সংস্কার এবং বেশ কিছু জায়গায় ডাবল লাইন নির্মাণ করা প্রয়োজন। জোড়াতালির সংস্কারে রেলসেবা চলমান আছে; কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। জরাজীর্ণ এ রেলপথকে প্রয়োজনীয় গতি দিতে পারছে না, সময়সূচি ঠিক রেখে মানুষকে সেবা দিতে পারছে না, দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। রেল বিদ্যুৎচালিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। এ জন্য স্টেশনগুলো আধুনিকীকরণ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে যেসব স্টেশন আধুনিকীকরণ করা হয়েছে, তা জনকল্যাণ বিবেচনায় হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমাদের প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে বগির পাটাতনের সমন্বয়হীনতার ফলে শিশু-বৃদ্ধ রোগীদের জন্য ট্রেনে ওঠানামা খুবই কঠিন। এ যুদ্ধ চোখে দেখা যায় না। স্টেশনের আরও অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সিগন্যাল সিস্টেম, যাত্রীদের অপেক্ষা কক্ষ, খাবার পানির ব্যবস্থা, দিন-রাতের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে রেলস্টেশনের আধুনিকীকরণ করা হলে মানুষ উপকৃত হবে এবং রেল পরিষেবা লাভবান হবে। 

আমাদের দেশে লোকসান কমানোর সহজ পথ যাত্রীর ভাড়া বৃদ্ধি। যাত্রীসেবার মান বাড়ানো হলে তারা হয়তো প্রতিবাদ করে না; কিন্তু এটা লোকসান কমানোর যথাযথ পক্রিয়া হতে পারে না। দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অব¯’া বিচারে নিয়ে যাত্রীদের ঘাড়ে বোঝা চাপানো প্রয়োজন। রেলওয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, চুরি, লুটপাট, জালিয়াতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে এ পর্যন্ত অনেক সম্পদ হাতছাড়া হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। ৮০-এর দশকে এরশাদ সরকার রেলের জমি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন উন্নয়নমুখী সংস্থার কাছে অল্প কিছু জমি বিক্রি করা হয়। পড়ে থাকা জমির ওপর চোখ পড়ে রেলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের। রেলে জমি দখল ও বেহাত হতে থাকে। রেলওয়ের কয়েক হাজার একর মূল্যবান জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে পড়ে আছে আজও। বিপরীতে এস্টেট বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে যুগযুগ ধরে রেলের শত শত মামলা ঝুলে আছে। নিষ্পত্তি হচ্ছে না। অথচ এখনো রেলওয়ে এককভাবে বেশি সম্পদের মালিক। তারপরও রেলওয়ে লোকসানকারী প্রতিষ্ঠান। জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলে রেল নিজ সম্পদেই মানুষের কল্যাণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম। সাধারণ মানুষের সেবা যদি সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষের কাম্য হয়ে থাকে, তাহলে স্থানীয় মানুষের ছোট ছোট প্রত্যাশাগুলো মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। স্থানীয় জনগণের সুবিধা বিবেচনা করে পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করা গেলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। জনকল্যাণের সরকারের কাছে এটাই কাম্য।

লেখক: এম আর খায়রুল উমাম
সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //