কাগজে ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ কী?

সংবাদমাধ্যম নিজেই অনেক সময় সংবাদ। ২০১৬ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা ইনডিপেনডেন্ট বন্ধের খবরটি যেমন সারা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছিল, তেমনি এবার আরেকটি খবরও সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের ভাবাচ্ছে, তা হলো- যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা টেলিগ্রাফ বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সার্কুলেশন তথা এর বিক্রি ও মুনাফা কমে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এরইমধ্যে টেলিগ্রাফ মিডিয়া গ্রুপের (টিএমজি) মালিকরা তাদের সব সম্পত্তি বিক্রির জন্য একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়, টেলিগ্রাফ পত্রিকা ও বিশেষ সংস্করণ সানডে টেলিগ্রাফও রয়েছে এই বিক্রির তালিকায়। ১৭ অক্টোবর টিএমজি গ্রুপের বার্ষিক পরিসংখ্যান তুলে দিয়ে বিবিসি বলছে, গত অর্থবছর টিএমজির মুনাফা ছিল ৯ লাখ ইউরো, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৯৪ শতাংশ কম। এরকম বাস্তবতায় পত্রিকাটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন মালিকরা। এর আগেও কয়েকবার টেলিগ্রাফ বিক্রির গুঞ্জন উঠেছিল। কিন্তু প্রতিবারই তা অস্বীকার করেছে মালিকপক্ষ। এবার সেই গুঞ্জনই সত্য হলো। ১৮৫৫ সালের ২৯ জুন দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। দুই ভাই এইডান বারক্লে ও হাওয়ার্ড বারক্লে ২০০৪ সালে তাদের বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা পান। 

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ বিবিসি অনলাইনের একটি খবরের শিরোনাম ছিল- ‘কাগজে আর ছাপা হবে না দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট।’ যেখানে লেখা হয়, ‘ব্রিটেনে ৩০ বছরের পুরনো একটি সংবাদপত্র ইন্ডিপেনডেন্ট আজ তার সবশেষ প্রিন্ট সংস্করণ বাজারে ছেড়েছে। এখন থেকে এই পত্রিকাটি শুধু অনলাইনেই প্রকাশিত হবে।’ এটিই ব্রিটেনে মূলধারার প্রথম কোনো পত্রিকা যারা নিজেদেরকে পুরোপুরি মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা থেকে অনলাইনে রূপান্তর ঘটালো। ১৯৮৬ সাল থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়ে আসছিল।

বিবিসির খবরে বলা হয়, পত্রিকাটি যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল, তখন দৈনিক এর প্রচারসংখ্যা ছিল চার লাখের মতো। কিন্তু পত্রিকাটির ছাপার সংস্করণ বন্ধ হয়ে যাওযার আগপর্যন্ত তা কমে এসেছিল মাত্র ৪০ হাজারে। এই ঘটনার সাড়ে তিন বছর পরে যুক্তরাজ্যেরই আরেকটি সংবাদপত্র সংবাদ শিরোনাম হলো।

তবে টেলিগ্রাফ বিক্রির সংবাদটি কেবল ব্রিটিশদের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের পাঠকদের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ইন্টারনেট তথা অনলাইন সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে বাংলাদেশেও মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকদিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। এই উদ্বেগের আরেকটি কারণ- কাগজে ছাপা পত্রিকার জায়গা যেসব অনলাইন সংবাদপত্র বা নিউজ পোর্টাল দখল করছে, তাদের কয়েকটিই শুধু মানসম্পন্ন। আবার ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব তথ্য ও গুজব ছড়াচ্ছে, তারই বা ভবিষ্যৎ কী? 

তথ্যপ্রযুক্তির ওপর মানুষ যত বেশি নির্ভরশীল হচ্ছে, তত বেশি কমছে কাগজে ছাপা জিনিসের প্রতি তার নির্ভরশীলতা। অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে পেপারলেস বা কাগজমুক্ত অফিস ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ তাদের সব কাজই হয় কম্পিউটারে। এতে একদিকে যেমন কাগজের খরচ বাঁচে, তেমনি কাগজের জঞ্জালের হাত থেকেও মুক্তি মেলে।

যারা নিয়মিত বাসায় এক বা একাধিক পত্রিকা রাখেন, মাস শেষে তাদের ঘরে কাগজের যে স্তূপ জমে যায়, সেটি এখন অনেকেরই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এ কারণেও অনেকে বাসায় নিয়মিত সংবাদপত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে শোনা যায়।

তবে কাগজে ছাপা সংবাদপত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোবাইল ফোন। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে যদি এখন ১০ কোটির বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাহলে ধরে নেয়া যায় অন্তত এর অর্ধেক জনগোষ্ঠী মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আর যারা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তিনি কী কারণে বাসায় কাগজে ছাপা পত্রিকা রাখবেন, যেখানে তিনি প্রতি মুহূর্তেই মোবাইল ফোনে খবর জানতে পারছেন?

মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর এই সংখ্যাটি ক্রমেই বাড়তে থাকবে এবং সঙ্গত কারণেই কাগজে ছাপা পত্রিকার চাহিদা কমতে থাকবে। এমন বাস্তবতা মাথায় রেখে সবকিছু ডিজিটালাইজড করার প্রক্রিয়া আরও আগেই শুরু হয়েছে। সঙ্গত কারণে সেই ধাক্কা সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত দেশের সংবাদমাধ্যমও। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় পত্রিকা প্রথম আলো আরও বেশ কয়েক বছর আগেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেছিল যে, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় কাগজে ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যে কারণে তারা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে গুরুত্ব দেয়। অনলাইনের জন্য আলাদা টিমও গঠন করে। শুধু তা-ই নয়, অনলাইন সংস্করণকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারা ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। কিন্তু অন্যান্য দৈনিক সংবাদপত্রগুলো কাগজে ছাপার পাশাপাশি অনলাইন সংস্করণ চালু করলেও সেগুলো খুব বেশি পাঠকপ্রিয়তা পায়নি বা ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক হয়ে ওঠেনি। কেন হয়নি সেটি অন্য বিতর্ক।

পক্ষান্তরে, অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিপত্তিও এরইমধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু অনলাইন সংবাদপত্র নিজেদের বস্তুনিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারলেও, অখ্যাত অনামি সব ডটকমের উদ্ভট, বানোয়াট আর উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ভুয়া খবর যেভাবে প্রতিনিয়ত ফেসবুকে শেয়ার হচ্ছে, তা বিশ্বাস করার লোকের সংখ্যাও কম নয়। ফলে সংবাদের নামে বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে এই তথাকথিত অনলাইন সংবাদপত্রগুলো। ইন্টারেনেটের সুবিধা নিয়ে এখন যে কেউ চাইলেই একটা অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে সম্পাদক হয়ে যাচ্ছেন। গাড়িতে প্রেস স্টিকার লাগিয়ে ঘুরছেন। সম্প্রতি সরকার অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে নীতিমালার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিলেও আখেরে এটি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে বা সত্যিকারের সাংবাদিকতার চর্চা কতটুকু হবে, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

সুতরাং ছাপা কাগজের ভবিষ্যৎ খারাপ বলে আমরা একদিকে যেমন ইন্টারনেট মাধ্যমকে গুরুত্ব দিচ্ছি, তেমনি ইন্টারনেটে সংবাদমাধ্যমের নামে আমরা আসলে কী উৎপাদন করছি, সেই তর্কটিও করা দরকার। তাছাড়া কাগজে পড়া আর মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে পড়ার মধ্যে তফাৎ ঢের। পাঠক হিসেবে বলতে পারি, ডিজিটাল বই পড়ায় আনন্দ কম। একটানা ৫ ঘণ্টা কাগজের বই বা পত্রিকা পড়া সম্ভব। কিন্তু একটানা এক ঘণ্টা মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা বেশ কষ্টকর। এটা চোখের জন্যও ক্ষতিকর। সুতরাং পাঠকের কথা বিবেচনা করেই হয়ত মুদ্রিত পত্রিকা ও বই টিকে থাকবে। কিন্তু সেই সংখ্যাটি যে বিপুল পরিমাণে কমে যাবে, সে ইঙ্গিত আরও কয়েক বছর আগেই পাওয়া গেছে। সুতরাং সেই বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি আমাদের আছে কি?


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //