দুটি পদ্ধতিতে দেশে নিরসন হতে পারে মহামারি করোনা

উনিশ সালের কুরবানি ঈদ করে ঢাকা এসেছিলাম, ইচ্ছে ছিলো সামনের ঈদ করতে বাসায় ফিরবো কিন্তু হলো না, মরণব্যাধি কভিড-১৯ দামামা বাজিয়ে প্রশ্রয় নিলেন ঢাকার বুকে। এরই মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পনের দিনের সাধারণ ছুটি মঞ্জুর করেন। তখন শুধুমাত্র বন্ধ হয়েছিল সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য সব কর্মক্ষেত্র খোলা ছিলো। আসলে তখন দেশ বুঝতে পারেনি যে পরবর্তীতে আজকের এ নাজেহাল অবস্থা হবে কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আক্রান্তের সংখ্যা একজন দুইজন তিনজন করতে করতে যখন সংখ্যাটা সংঘাতের মধ্যে চলে আসে তখন সমস্ত দেশ লকডাউন দিতে বাধ্য হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্যি সে সময়েও বিমানবন্দরগুলো কার্যকর ব্যবস্থা নিলেও থামতে পারেনি বিভিন্ন জেরে যার অছিলায় দেশ জুড়ে আজকের এ ভোগান্তি। ১৬ মার্চ বাসায় ফিরি পনের দিনের ছুটি কাটানোর নিমিত্তে। বাসায় এসে কয়েকদিন থেকে আবার রওনা দেই ঢাকার উদ্দেশ্যে। পথে মধ্যে রাজশাহীতে বোনের বাড়িতে থাকি , সেখানে দুইদিন থাকতে না থাকতেই ২৫ মার্চ থেকে পড়ে গেলাম লকডাউনের মধ্যে। 

তারপর তারিখের পর তারিখ যায় দেখলাম সমস্ত দেশ অনিয়মতান্ত্রিক লকডাউনে পড়ে গেলো। সরকার অসহায় দুস্থ মানুষের জন্য বিভিন্ন সহযোগিতা, কৃষকদের জন্য ভর্তুকি দিলেন তা সহসাই প্রশংসিত। পেটুক জনপ্রতিনিধির অসমবন্টন, দুর্নীতি, ভোগান্তিতে সরকার বাধ্য হয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহযোগিতায় শরণাপন্ন হন।

দিন যায় দিন আসে এভাবে দুই মাস কেটে যায় করোনা আক্রান্ত দীর্ঘ হতে থাকে। তখনো রাজশাহী শহর করোনামুক্ত ও প্রকৃতির দারুণ ঝলমল দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমসহ গণমাধ্যম প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যথাযথ পদক্ষেপ ও নিয়মতান্ত্রিক চলাচল এবং জনগণের সচেতনতার কারণে রাজশাহী শহর করোনামুক্ত ছিলো। শহরে প্রবেশ/বাহিরে ছিলো কড়া নজরদারি। তখন পর্যন্ত করোনামুক্ত রাজশাহী শহরে এগুলোই মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

বোনের বাড়িতে টানা দুই মাস আটকে থাকায় খুব বাজে সময় কাটিয়েছিলাম, ঈদের আগ মুহূর্তে লকডাউন শিথিল হলে পালিয়ে আসি নিজ বাড়িতে। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লভস, স্যানিটাইজার ছাড়া অন্য কোনো সুরক্ষা ছিলো না প্রতিরোধ করবার। পথেই এলাকার এক বন্ধুর সাথে রওনা দেয় গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বন্ধুকে দেখে অবাক হয়েছিলাম- রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে তার কিছু ব্যক্তিগত সুরক্ষার পরামর্শ দিলে সে তা কিনে ফেললো। উচ্চ হারে ভাড়া ও ঘনঘন গাড়ি পরিবর্তন করতে হওয়াই আমাদের প্রায় পাঁচগুণ বেশি ভাড়া দিতে হয়। ভয়ে ভয়ে বাসায় আসলাম। শুরুতে এলাকার অসচেতন অবস্থা দেখে মাথা খারাপ করি পরবর্তীতে তা অভিযোজন করতে সক্ষম হই। মাথা ভর্তি চুল, অসহ্য গরমের মধ্যে সারাক্ষণ রুমে থাকা সত্ত্বেও টানা স্বেচ্ছায় টানা চৌদ্দদিন ঘরবন্দি সময় কাটালাম। এলাকার ধানের,আমের মৌসুম থাকায় বরাবরের মতো হৈ হুল্লোড় চলছে কেউ আক্রান্তও হচ্ছে না। অবাক হলাম, স্রষ্টা হয়তো আমাদের অশেষ রহমতের চাদরে ঢেকে রেখেছেন আমার এলাকার মানুষদের। নাহলে করোনার যে প্রাদুর্ভাব তা এক সপ্তাহে সমস্ত জেলা কাভার করে দিতে পারতো ইনশাআল্লাহ। আসলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় করোনা নাই নাহলে আমাকেও হতে পারতো খুব ভয়ে ছিলাম রাজশাহী থেকে আসার পর।

১৬ জুন কাঁটায় কাঁটায় ৩ মাস পূর্ণ হলো। বাড়িতে বসে বসে অযথা সময় কাটালাম। এই সময়ে যা যা শিখলাম দেখলাম তার সামান্যতম অংশই শেয়ার করছি মাত্র।

সত্যি কথা বলতে কি মরণ করোনার আগেও ছিলো, এখনো আছে। সময় নষ্ট না করে গন্তব্যে ফিরে যেতে চাই।

উপরোক্ত কথাগুলো কেন বললাম তার কিছু ব্যাখ্যা.. খেয়াল করলাম যারা উচ্চ বেতনভোগী চাকুরীজীবি শুধুমাত্র তারাই দীর্ঘ লকডাউন সমর্থন করে আসছে, খেয়াল করে দেখবেন আসলে এঁরা বাস্তবতার বাইরে জীবন যাপন করে। এঁরা কখনো জোগানোর অভাবে একদিন না খেয়ে থাকেন নি। এঁরা বুঝবে কিভাবে আমার দেশের অভাবী , অস্বচ্ছ, অসহায় নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের জীবন যাপনের বাস্তবতা!

নিঃশর্ত, উপরের কটা লাইন পড়ে চাকুরীজীবীরা কাঁদা ছোড়াছুড়ি করবেন। তা যদি হয় বেশ ভালো, আপনার বিবেক জাগ্রত করতে সক্ষম হবে পরের লাইনগুলো।

গত পরশু দিন, আমের বাগানে বিকালে একা বসে ছিলাম। আমাদের পুরনো কাজের ছেলে সে, দাদা বলে ডাকি। অত্যন্ত গরীব মানুষ, বাড়িতে চারজন খানাপিনা ওয়ালা, একজন উপার্জনকারী, নিজের জায়গাজমি নাই কিছু অন্যের খাটে খুঁটে, খায় এইতো চলে। বাড়ি ঘর করতে পারেননি, মেয়ের বিয়ে দিতে পারেননি, তিনটা গরু পুষছেন বিক্রি করে লাখ দুয়েক টাকা পেলে বাড়ি দিবে, তারপর মেয়ের বিয়ে দিবেন সে উদ্দেশ্যে গরু চরাচ্ছিলেন পাশের জমিতে। আমাকে দেখে সামনে আসলেন গাল গল্প শুরু করলেন। অনেক কিছু জানলেন আমার মাধ্যমে দেশের কি খবরাখবর, করোনা কখন যাবে, ঢাকার দিকে কেমন পরিস্থিতি সবই বললাম। আমিও তাঁর মতিগতি বোঝার জন্য প্রশ্নোত্তর করলাম।

এক সময় তিনি নিজেই বললেন, এমনি গরীব রাষ্ট্র লকডাউন দিয়ে সরকার কত দিন চালাইবে, এতো মানুষকে বসে বসে খাওয়া সম্ভব লয় সরকারের। আমি তাঁর কথা শুনে থমকে গেলাম এজন্য যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত ভূমিহীন শ্রমিকটার এতো সুগভীর চিন্তা সেজন্য অবাক হয়েছিলাম। আশার আলো হচ্ছে এখন আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজনরাও ভাবতে পারে দেশ নিয়ে, সংকট নিয়ে।

আমারও একই কথা এতো বেকার জনগোষ্ঠীর দেশে কিভাবে বসে বসে খাইয়ে ত্রাণ, ভর্তুকি দিয়ে দেশ চালানো সম্ভব। করোনা প্রচলিত আইনকানুনে পুরোপুরি নির্মূল করা অসম্ভব। কোনো দেশেই এটা সম্ভব নয়। করোনা বৈশ্বিক ভাবে নির্মূল করতে হবে। এজন্য প্রাথমিক ভাবে ২ টা পদ্ধতির যেকোনো একটি অনুসরণ করা যেতে পারে।

১. যদি মনে করেন টানা লকডাউন থামা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে শেষ বারের মত টানা পনের দিন কারফিউ দেয়া যেতে পারে, এই  পনের দিনের মধ্যে করোনা টেস্ট করে সবাইকে বাড়ি থেকে বের করতে হবে। এর আগে কেউ বাড়ি থেকে প্রশাসনের (শুধুমাত্র ইউএনও পর্যায়ের) অনুমতি ছাড়া বের হলে গুলি চালানো হোক। এভাবে করোনা টেস্ট করতে ব্যয়বহুল মনে হলেও যেভাবে দেশের অর্থনীতি প্রতিদিন যে হারে কমছে তার তুলনায় এদিকে গেলে ফলপ্রসূ হতে পারে। সুতরাং, কঠোরভাবে দমন করতে হবে।

২. (ক) যদি লকডাউন দিতেই হয়, প্রচলিত লকডাউনের প্রভাবে দেশে কর্মসংস্থান চ্যুত হয়েছে ফলে কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে সরকারি অনুদান, সহায়তা, ত্রাণ, ভর্তুকি দিতে বাধ্য হয়েছেন।এভাবে দুই মাস, একমাস চালানো সম্ভব, করোনার যে পরিস্থিতি তাতে কখন করোনা মুক্ত হবে তা বলা মুশকিল।আর এভাবে সরকারের দেশ চালানো অসম্ভব। সেজন্য বিকল্প কিছু ভাবতে হবে, আর সেটা হতে পারে নিম্নের পদ্ধতিতে চলমান পরিস্থিতির আলোকে।

বিভিন্ন সরকারি চাকরিজীবী যাদের করোনার সময় কালীন অফিস করতে হয়না অথচ মাসিক বেতন পান পঞ্চাশ হাজারের বেশি তাদের পঞ্চাশ হাজারের উপরের সংখ্যা সমতুল্য বেতন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রেখে দেওয়া। নিশ্চয় এখন অনেকেই বলবেন যে আমাদের বাসা বাড়ি ভাড়ায় তো হচ্ছে সত্তর-আশি হাজার টাকা, সে ক্ষেত্রে আমি বলবো যাদের মাসিক সত্তর-আশি হাজার টাকা ভাড়া দেয়ার মত ক্ষমতা থাকে তাদের নিশ্চয়ই ছয় মাস বসে থাকার মত উপার্জন করা আছে।এই খাতের আওতায় আনা যেতে পারে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিনিধি।

২. (খ) ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক, রাজনৈতিক দল, সংসদ সদস্য এবং সিটি মেয়রদের কাছ থেকে অর্থ নেয়া যেতে পারে। এই অর্থ করোনাকালীন সময়ে যাদের উপার্জন করার সুযোগ নেই তাদের বিভিন্ন সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠান অথবা পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার এবং বিজিবির মাধ্যমে তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সুতরাং, আমি মনে করি- কভিড-১৯ একটি জাতীয় সমস্যা। এ সময় সমস্বরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মোকাবেলা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কাজেই, এভাবে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

শাহিনুল ইসলাম সাগর
 শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //