সেলিব্রেটিদের আত্নহনন এবং 'সুইসাইড আইডিয়েশন'

প্রথমেই বলে রাখা ভালো; এক সমীক্ষায় দেখলাম প্রতি ২০টি সুইসাইডের ঘটনার ১২টির পেছনেই দায়ী 'সুইসাইড আইডিয়েশন'! অন্যভাবে বললে সুইসাইডের জন্য মোটিভেট হওয়া। 

এবার আসি আমার নিজের উপলব্ধি! হঠাৎ আজ আমি নিজেও কিছুটা ডিপ্রেশনে পড়ি! যদিও আমি খুব একটা ডিপ্রেশনকে ভেতরে জায়গা দিই না! একে চমৎকারভাবে কাটিয়ে উঠার একটা তীব্র গুণ আমার মধ্যে আছে! অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন ডিপ্রেশনে পড়ে এসবের প্রথম শব্দটা চিন্তা করাও আমার জন্য অস্বাভাবিক। তবে পৃথিবীর আর সকল মানুষের মতো মাঝে-মাঝে ডিপ্রেস্ড হওয়াটা আমার মধ্যেও আছে। 

এদিকে বলিউডের এক অভিনেতার সুইসাইডের খবর এর মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এত এত মানুষের শেয়ার ও সিম্প্যাথি দেখে আমারও কিছুটা খারাপ লাগলো! তবে একটু পরই আমি খেয়াল করলাম আমার একটু আগে হওয়া ডিপ্রেশনটা আজ আমাকে বার বার সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাতে বাধ্য করছে! সাথে তীব্র একটা ভিজুয়ালাইজেশন আমার চোখে ভেসে উঠছে! যে আমার জন্যও হয়তো এভাবে না হোক বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে ফেসবুকে শেয়ার হবে! আমার ডিপ্রেশনের জন্য হয়তো রিজনটা বের করে সবাই সেটা খবর মর্মান্তিকভাবে শেয়ার করবে! হয়তো আমার সব চিন্তাগুলো এভাবে বের হয়ে আসবে! 

বারান্দায় গিয়েও ভাবলাম যে- কাল এখানে অনেক মানুষ হবে হয়তো! নিশ্চয় সবাই অনেক আপসোস করবে আমার জন্য যেটা আমি এতদিন বুঝাতে পারছিনা কাউকে! আবার রুমে এসে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছি! এর মধ্যেই খেয়াল করলাম আমার মাথায় বারবার সুশান্তের বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছে! অর্থাৎ আমি যা জীবনে চিন্তা করিনি সে এখন সুইসাইড আইডিয়েশন নিয়ে ভাবছি! 

অর্থাৎ আমার এই চিন্তা করার পেছনে মোটিভেশনটা মোটামুটি একটা ভিত্তি হিসেবে শক্ত হয়ে গেছে! এরপরই সুইসাইড আইডিয়েশন এবং ইম্প্যাক্ট অফ সেলিব্রিটি সুইসাইড অন সোস্যাইডাল আইডিয়েশন নিয়ে একটু পড়তে থাকি!

হু এর রিপোর্টে প্রতিদিন সুইসাইডে জীবন সমাপ্তি করার হার প্রতি সেকেন্ডে ১জন! যেটা বর্তমানে বিশ্বব্যাপি চলা করোনাভাইরাস মহামারির চাইতেও মারাত্নক! এবার আসি ইম্প্যাক্ট অফ সেলেব্রিটি সুইসাইডের ব্যাপারে।

২০১৬ সালে হংকং এর সুইসাইড এটেম্পটকারীদের নিয়ে হংকং স্পেশাল এডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিয়ন একটা জরিপ চালায় যাদের বয়স ছিলো তখন ২০-৫৯ বছরের মধ্যে। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিলো " তারা কি সেলিব্রিটি সুইসাইড দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো কিনা?" যে ব্যাক্তিরা সেলিব্রিটি আত্মহত্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়নি এমন লোকদের চেয়ে তাদের সংখ্যা ৫.৯৩ গুণ বেশি ছিলো!

অর্থাৎ আমরা নিজের অজান্তেই সেলিব্রিটি সুইসাইডকে সমাজের মধ্যে একটা প্রভাবক বানিয়ে দিচ্ছি! সেটা কিভাবে চলুন একটু দেখি-

গতকাল ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি শেয়ার হওয়া পোস্ট ছিলো সুশান্তের সুইসাইড! এটা স্বাভাবিক। বলিউডের একজন জনপ্রীয় তরুণ অভিনেতা সুইসাইড করবে আর তা ট্রেন্ডে থাকবে এটা নিয়া লিখালিখির কিছু নাই! কিন্তু আমার লিখাটার উদ্দেশ্য ঠিক অন্য জায়গায়। কারন আমার ফেসবুক-টুইটারে বন্ধুদের মধ্যে যারা তাকে নিয়ে পোস্ট লিখেছেন তাদের সবারই পোস্টে কোনরকম আত্নহত্যার বিরুদ্ধ নিয়ে কোনরকম মন্তব্য পাওয়া যায়নি! মোটামুটি আত্মহত্যাকে অতি সাধারণ মৃত্যু বা পরিণতির মত মেনে নিয়েই সবাই শুসান্তের আত্নহুতির বিষয়টি যে গ্রহণযোগ্য নয় তা উল্লেখ করেননি! সিনেমায় যেমন নায়ক-নায়িকাদের বিভিন্ন দৃশ্য দেখে আমরা প্রেমে পড়ে যাই কিংবা হাসি-কান্নায় মেতে উঠি! তেমনি তাদের দৈনন্দিন লাইফস্টাইলগুলোকেও অনুকরণ করাটা হোমো সেপিয়েন্সের একটা কমন বিষয়! অর্থাৎ আপনি সমাজের জনপ্রিয় ব্যাক্তিদের যদি ফলো করেন তাহলে তাকে আপনি অনুকরণ করার একটা চেষ্টা করেই যাবেন। তারা যেমন সিনেমায় আপনার জীবনের চিন্তাধারা বদলে দিতে পারে তেমনি তাদের দৈনন্দিন লাইফস্টাইলও আপনাকে প্রভাবিত করবে। কারণ ভিজ্যুয়ালি তাকে আপনি সিনেমার মানুষটিই কল্পনা করেন। আর তার নেয়া আত্নঘাতি সিদ্ধান্ত আপনাকে প্রভাবিত করবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে প্রধান নিয়ামকটা হচ্ছে আমাদের সোস্যাল মিড়িয়া। এতে সেলিব্রিটিদের সুইসাইডকে অনেকটা মনের অজান্তেই খুব পজিটিভভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে আপনার-আমার মাঝে! আর যে কাজটা করছি আপনি-আমি নিজেই! অর্থাৎ আমাদের মস্তিষ্ককে পরিবর্ধন করার চিন্তাটা আমাদের মধ্যেই আসতে হবে! আত্মহত্যা একটা বর্জনীয় জিনিস যেটা সে সেলিব্রিটি হোক আর সাধারণ কেউ হোক! আপনি সেটা সবসময় পজিটিভলি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকুন! 

আর আমাদের পাবলিক ফিগার মানুষগুলোকেও বুঝতে হবে আপনি যেটা করছেন সেটা আপনার পরে অনেককেই প্রভাবিত করবে। আপনার সিনেমা যেমন মানুষকে বদলে দেয়ার প্রয়াস নিয়ে বানানো হয় তেমনি আপনিও একটা প্রভাবক হিসেবে সামনে চলে আসেন। হ্যাঁ! আত্মহত্যা মানুষ শখ করে করে না! কিন্তু জীবনও সবসময় খুব সুন্দরভাবে নিজের মত চলবে না। আপনার সামনে সবরকম পথই উন্মুক্ত হবে। শুধু আপনাকে এর জন্য ইচ্ছা-সাহস আর পরিশ্রমে মনোনিবেশ করতে হবে! 

আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে ধর্মীয় দিক থেকেও এই সুইসাইড বা আত্মহত্যা খুবই ঘৃণ্য একটা অপরাধ। এ ব্যাপারে আমাদের ধর্মীয় বক্তাদের ধর্মীয় ব্যাখাগুলোকে আরো ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। কেননা সব খারাপ কাজ আর হারাম কাজ নিয়ে ইউটিউবে তাদের নানারকম ওয়াজ ও বক্তব্য পাওয়া গেলেও আত্মহত্যা যে খুব ভয়ানক একটা পাপ এতে তারা উদাসীন! 

আত্মহত্যা নিয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘আর (হে মুমিনগণ!) তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২৯)।  হাদীস শরীফে বলা হয়েছে " যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও তার সেই যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, তার সেই যন্ত্রণাকেও জাহান্নামে অব্যাহত রাখা হবে।’ (সহিহ বুখারি, খণ্ড ২, হাদিস নং ৪৪৬)"।

অর্থাৎ, আমাদের এখনই বুঝতে হবে, জানতে হবে যে আমরা যা করছি লিখছি তার দ্বারা সমাজ উপকৃত হচ্ছে না অপকৃত? সবশেষ, আত্নহত্যার সমাজে কোন জায়গা নেই। আর সে যেই হোক তাকে উপস্থাপন যেন তার কৃতকর্মকে সবার মাঝে প্রভাবিত না করে।

আফতাব শুভ
শিক্ষার্থী,
ইন্সটিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, ধানমন্ডি, ঢাকা।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : সুইসাইড

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //