চাকরিতে তরুণদের যেসব দক্ষতা কাজে লাগতে পারে

তরুণ প্রজন্মের যারা পড়াশুনা করছেন, চাকরির বাজারে প্রবেশ করার আশা নিয়ে যারা এগোচ্ছিলেন, যারা কোন কিছু শুরু করতে চেয়েছিলেন তাদের সামনে রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা যেভাবে ভাবছিলেন তা এখন পুরোটাই বদলে দিতে হবে। মহামারি করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) শুরুর পর থেকে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, গুটিয়ে গেছে বহু ব্যবসা। এর মধ্যেও কোন পেশায় টিকে আছেন এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদেরও কাজের ধরন পুরোপুরি বদলে গেছে।

দেশে চাকরিতে নিয়োগ বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বড় অনলাইন পোর্টাল বিডিজবস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর গণমাধ্যমকে বলছেন, দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত হওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে ব্যাঘাত ঘটেছে তাতে তাদের প্ল্যাটফর্মে চাকরিতে নিয়োগের বিজ্ঞাপন এপ্রিল মাসে ৮০ শতাংশের মতো কমে গিয়েছিলো।

মে মাসেও পরিস্থিতি প্রায় একই রকম ছিলো। তিনি বলছেন, এখন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আবার বাড়লেও পরিস্থিতি আগের পর্যায়ে ফেরেনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নতুন নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠান তা স্থগিত রেখেছে। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু কাজে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, বলছিলেন ফাহিম মাশরুর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ই-কমার্স খাতে।

বিশ্বব্যাপী মানুষজন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে সরাসরি দোকানে না গিয়ে অনলাইনে কেনাকাটা করছেন। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাই প্রায় সব ধরনের পণ্যের প্রতিষ্ঠানকে ধীরে ধীরে অনলাইন বিপণনে যেতে হচ্ছে।

মাশরুর বলছেন, অনলাইনে বিপণনের ব্যবসা ও এর সাইটগুলো চালাতে গেলে তার সাথে নানান বিষয় যুক্ত রয়েছে। তাই এই খাতে নিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে, ভবিষ্যৎ কাজের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ই-কমার্স খাতে বেশ কিছু খন্ডকালীন কাজের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। যেমন ই-কমার্সের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করা, ভিডিওর মাধ্যমে ইউটিউব ও ফেসবুকে পণ্যের মার্কেটিং, এসব প্ল্যাটফর্মে প্রচারের ভিডিও ধারণ করার জন্য ভিডিওগ্রাফি, অনলাইন শপিং-এর পণ্য ভোক্তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে পরিবহনের কাজ। যার একটি স্মার্টফোন ও মোটরসাইকেল রয়েছে সে কিন্তু সহজেই এই কাজটি করতে পারে। শুধু লাগবে মানসিকতার পরিবর্তন।

তিনি বলছেন, এখন যেহেতু ফিজিকাল মুভমেন্ট কম হচ্ছে তাই মার্কেটিং-এর কাজও অনলাইনে চলে যাবে। যারা আগে কোন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পণ্যের মার্কেটিং করতেন তাদের এখন ভোক্তাদের সাথে অনলাইনে যোগাযোগ বিষয়ক দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এসব কাজ বাড়ি বসেই করা যায়।

ফাহিম মাশরুর আরো বলছেন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন অর্থাৎ গুগুলোর মতো সার্চ ইঞ্জিনে কোন কিছু খুঁজলে নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানের পণ্য সবচেয়ে উপরের দিকে থাকবে। অনলাইন শপিং পোর্টালগুলো সেজন্য লোক নিয়োগ দিয়ে থাকে। তার মতে ই-কমার্স যেহেতু বাড়ছে তাই এই ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বাড়বে। যা তরুণদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করবে।

তিনি বলছেন, ভোক্তার ক্রয় প্রবণতা সম্পর্কে গবেষণা, তার ক্রয়ের ডাটাবেইজ সংরক্ষণ সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনে কাজে লাগে। তরুণরা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের এই স্কিলটা যদি অর্জন করেন তা বেশ কাজে আসবে। কারণ করোনাভাইরাস থেকে আমরা বোধহয় সহসাই মুক্তি পাচ্ছি না। তার মানে ই-কমার্স সামনে আরও দীর্ঘদিন ব্যবসা ধরে রাখবে।

এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের নির্বাহী সদস্য সুমন আহমেদ সাবির গণমাধ্যমকে বলছেন, একটি ই-কমার্স সাইট তৈরি করতে ও চালাতে গেলে প্রচুর ছবি লাগে এবং সেসব ছবি সাইটে দেবার জন্য ইমেজ প্রসেসিং দরকার হয়। যেকোনো অনলাইন শপিং পোর্টালে গেলে দেখতে পাবেন পণ্যটির কয়েকটি ছবি ও পণ্যটি সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। বিভিন্ন দিক থেকে আকর্ষণীয় করে ছবি তুলে পণ্যটি সম্পর্কে আবেদন তৈরি করার চেষ্টা। বাংলাদেশে বসে বিদেশের প্রতিষ্ঠানের ইমেজ প্রসেসিং-এর কাজও হচ্ছে। ছবিগুলো তোলা ও সেগুলো প্রসেসিং-এ ভালো কাজের সুযোগ রয়েছে।

যুব উন্নয়নে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান বিশ্বাসে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি খাতে মানবসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন অজেয় রোহিতাশ্ব আল্‌ কাযি।

তিনি বলছেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এখন তাদের কর্মী সংখ্যা কমাচ্ছে। এখন যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝে গেছে যে কর্মীরা ঘরে বসেও কাজ করতে পারে তাই সেদিকেই অনেক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকছে। তাতেও কিছু লোক চাকরি হারাবে। পার্ট টাইম কর্মী নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে কারণ ফুল টাইম হলে তাকে অনেক বেনিফিট দিতে হয়। কিন্তু পার্ট টাইম হলে তাকে কাজ থেকে বাদ দেয়াও সহজ।

তিনি আরো বলেন, তরুণদের তবুও এখনো কিছু চাকরির সুযোগ রয়েছে। যেমন ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস' অর্থাৎ চাল, ডাল, লবণ, আলু, আটা ইত্যাদি পণ্য প্যান্ডেমিক শুরুর আগে লোকে বাজার থেকে খোলা কিনেছে। মার্চের পর থেকে প্রবণতা হচ্ছে মোড়ক-জাত ব্র্যান্ডেড আইটেম কেনার। এসব যারা বাজারজাত করে এসব প্রতিষ্ঠানে এখনো চাকরির সুযোগ রয়েছে।

অজেয় রোহিতাশ্ব আল্‌ কাযি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলছিলেন, চাকরিদাতারা তরুণদের কাছে কিছু বিষয় চান। উদাহরণ দিয়ে বলেন, নতুন কিছুর বুদ্ধি বের করা বা সৃজনশীলতা, খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, যোগাযোগ, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, প্রযুক্তিতে দক্ষতা এগুলো আমাদের তরুণদের দরকার। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। টিকে থাকতে হলে এগুলো শিখতে হবে।

বিডিজবস-এর প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, এরকম মহামারির সময় প্রায়শই খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তিনি বলেন, অনেক দেশেই কৃষিকাজ ও খাদ্যের সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হচ্ছে। যার ফলে খাদ্য সংকট একটা সমস্যা হতে পারে। এরকম সময়ে কৃষি একটা বড় ভূমিকা পালন করে। তরুণরা এখন ডেইরি, পোল্ট্রি ফার্ম, মাছ চাষ এসব কাজ করতে পারেন। যেমন দেখুন অনেকে এবারের কোরবানিতে গরুর খামার করে তা অনলাইনে বিক্রি করছেন। তরুণরা প্রযুক্তি ভালো বোঝে। কৃষিতে তারা প্রযুক্তি ব্যাবহার করে আরও ভালো উৎপাদন করতে পারবে। স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ প্রস্তুত খাতে আগের থেকে নিয়োগ অন্য সময়ের চেয়ে বেড়েছে। অনলাইনে সার্চ দিলেও সেটা দেখা যায়।

হাসপাতালগুলোতে নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও তাদের কার্যালয়ের জন্য নিজস্ব নার্স নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুশিয়ারি দিয়ে বলছে খুব সহসাই করোনাভাইরাস নির্মূল হচ্ছে না। সেই হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা খাতে জনবল চাহিদা বাড়বে। এই খাতে যেহেতু নির্ধারিত ডিগ্রি ছাড়া কাজ করা সম্ভব নয়, তাই সামনের দিনগুলোর জন্য তরুণরা এই বিষয়ে পড়াশোনার কথা ভাবতে পারেন, বলেন ফাহিম মাশরুর।

দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে। তরুণরা শিক্ষা নিয়ে হয়তো এখন ভাবতে পারছেন না। তবে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি শুরুর পর থেকে বিশ্বব্যাপী মানুষজন সম্ভবত একটি বিষয় নিয়ে ভাবছেন। আর তা হলো এই মহামারি কবে শেষ হবে আর মহামারি পরবর্তী জীবন কেমন হবে। তরুণদের জন্য সেই পরবর্তী জীবন মানে একটি ভালো পেশা। ডিগ্রি নিয়ে তারপর চাকরির পেছনে দৌড়ানোর প্রথাগত রীতি সম্ভবত পাল্টে যাবে। তাই নতুন যেসব দক্ষতা কাজে লাগতে পারে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।-বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //