পশ্চিমবঙ্গে এক ধরনের ‘সাইলেন্ট কমিউনালিজম’ অপারেট করে: আব্দুল মতিন

আবদুল মতিন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। পড়াশোনা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি ভারতের বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে গবেষণা করছেন। সম্প্রতি একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য আবদুল মতিন ঢাকায় এসেছিলেন। সাম্প্রতিক দেশকাল কার্যালয়ে তিনি ভারতে বাঙালি মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা, হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত

আপনার কাজ সম্পর্কে বলুন। 
আবদুল মতিন: এখন আমি স্বাধীন ভারতে বাঙালি মুসলমানদের পরিচয়, উন্নয়ন এবং তাদের কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছি। এখানে সাচার কমিটির প্রতিবেদনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যালঘুরা কেমন আছে- এ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এটাই এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রতিবেদন, যা দেশব্যাপী অন্তত একটা একাডেমিক ডিবেট ও ডিসকাশন তৈরি করে। আমি এখন মাইনরিটি ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। 

মূলত ধর্মীয় সংখ্যালঘু...
আবদুল মতিন: হ্যাঁ, মূলত ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং তার পাশাপাশি কাস্ট পলিটিকস, দলিত পলিটিকস। আমি ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে শুধু একটা হোমোজেনাস সংখ্যালঘু হিসেবে দেখি না। এখানে মুসলিমদের মধ্যেও অনেকগুলো দিক আছে। ‘দলিত মুসলিম’ বলেও একটা কনসেপ্ট আছে- যারা বর্ণপ্রথায় দলিত হিন্দু ছিল, ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। সামাজিকভাবে তো তারা ওই একই ধরনের পেশার সঙ্গে জড়িত। ধরুন, হিন্দু থাকার সময় যিনি কাঠমিস্ত্রি ছিলেন, মুসলিম হয়ে তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজই করছেন। এমনকি তাদের পারিবারিক উপাধিও একই আছে। যেমন- লস্কর, মণ্ডল ইত্যাদি। বর্ণকেন্দ্রিক পেশা থেকেই এই উপাধিগুলো এসেছে। অথচ শুধু ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তাদের কোনো পৃথক সুযোগ-সুবিধা নেই। সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে তারা একই জায়গায় রয়েছে; কিন্তু ধর্ম ভিন্ন হওয়ার কারণে শিডিউলড কাস্ট, শিডিউলড ট্রাইবরা যে সুযোগ পেয়ে থাকে, তারা সেটা পাচ্ছে না। যেমন- চাকরিতে কিছু সংরক্ষণ, বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ছাড় থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থাৎ, ‘মুসলিম’ বলে হোমোজেনাস আইডেন্টিটির কোনো বিষয় নেই। মুসলিমদের মধ্যেও যে অনেক বিভক্তি রয়েছে, আমি তা নিয়ে কাজ করছি। 

আপনার কাজের পরিধি কোথায় কোথায়?
আবদুল মতিন: আমার কাজের পরিধি পশ্চিমবঙ্গেই। তবে আমি জাতীয় পরিসরে একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরেছি। যেমন- পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কেরালা, অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, উত্তর প্রদেশ- যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম রয়েছেন। 

সাচার কমিটির প্রতিবেদন সম্পর্কে বলুন। ওই প্রতিবেদনের কোন বিষয়গুলো এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন? 
আবদুল মতিন: ভারতজুড়ে একটা কথা খুব প্রচলিত- কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বামপন্থী- অর্থাৎ কথিত সেক্যুলার দলগুলো ‘মুসলিম তোষণ’ করে। ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির মতো দলগুলো এই অভিযোগ করে থাকে। এখন তোষণ যদি করেই থাকে, তাহলে তো তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তোষণ মানেই তো বিশেষ খাতির করা, বিশেষ সুবিধা দেওয়া। 
সাচার কমিটি মূলত তিনটি বিষয়কে সামনে এনেছে- আইডেন্টিটি (পরিচয়), সিকিউরিটি (নিরাপত্তা) এবং ইকুইটি (উন্নয়নে অংশীদারিত্ব)। ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, জনতত্ত্ববিদ, অধিকারকর্মীদের সমন্বয়ে একটি উচ্চপদস্থ কমিটি গঠন করেন- যার কাজ হবে ভারতে মুসলিমদের আর্থিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিকগুলো কোন পর্যায়ে রয়েছে, তার একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা। (দিল্লি হাই কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রাজিন্দর সাচার ছিলেন ওই কমিটির প্রধান। তার নাম অনুসারে কমিটির নাম হয় ‘সাচার কমিটি’) সাচার কমিটি এর পরের বছর প্রায় চারশো পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জেন্ডার, সরকারি চাকরি, পার্লামেন্ট এবং অর্থনীতিতে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব- এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সাচার কমিটি ওই প্রতিবেদনে বলছে, স্বাধীন ভারতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব কমছে। কমতে কমতে এখন পশ্চিমবঙ্গ, যে রাজ্যে ২৭ শতাংশ বাঙালি মুসলমানের বাস, সেখানে সরকারি চাকরিতে রাফলি ২ শতাংশ মুসলমান রয়েছে। যেখানে উত্তর প্রদেশ, হায়দ্রাবাদ, কেরালায় খানিকটা ভালো। তামিলনাড়ুতেও খারাপ নয়। পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে কম। অথচ সেখানে কখনো বিজেপি ক্ষমতায় আসেনি। কংগ্রেস, বামপন্থী, বা তৃণমূল কংগ্রেস- যারা তোষণের রাজনীতি করে বলে অভিযোগ, তারা ক্ষমতায় থেকেছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে কংগ্রেস, ১৯৭৭ সাল থেকে বামপন্থীরা এবং গত ১০ বছর ধরে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই তিনটা দলের মধ্যে কেউ বিজেপির মতো দল নয়। তিনটিই কথিত সেক্যুলার দল। আমরা যদি সব দোষ বিজেপির ঘাড়ে চাপিয়ে দিই, সেটা সঠিক নয়। ওই কথিত সেক্যুলারদের আমলে ধীরে ধীরে সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব কমেছে। প্রথমে ১০, ৮, ৬, ৩ করতে করতে এখন ২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এটা সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় দাঁড়িয়েছে বাম আমলে। 
সাচার কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে আইডেন্টিটি, সিকিউরিটি এবং ইকুইটি- তিনটা পয়েন্টের কথা বলা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সিকিউরিটির সমস্যা ছিল না। বাম আমলের ৩৪ বছরে লিঞ্চিং বা দাঙ্গার মতো সাম্প্রদায়িক সংঘবদ্ধ আক্রমণ হয়নি। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে রাজনৈতিক সংঘর্ষে অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়। সেখানে যদি ১০০ জন নিহত হন, তার মধ্যে ৮০ জনই মুসলমান। মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশের পরই সবচেয়ে বেশি বন্দি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কারাগারে। যেখানে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বই বেশি। জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলমান হলেও বন্দিদের ৪০-৫০ শতাংশই মুসলমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে যা হয়, এটা অনেকটা সেরকমই- একঘরে করে দেওয়া, কৃষ্ণাঙ্গদের একটা নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। কলকাতায় নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকা ছাড়া কিন্তু মুসলিম ঘনবসতি পাবেন না। যাদবপুর বা দক্ষিণ কলকাতার কোনো কোনো এলাকায় কিন্তু নামের জন্য আপনি বাসা ভাড়াও পাবেন না। আমরা কলকাতাকে যেমন রোমান্টিসাইজ, গ্লোরিফাই করে দেখতে চাই, পিকচারটা কিন্তু আসলে সেরকম নয়। পিকচারটা কিন্তু খুবই কঠিন। 
আমি দুটো উদাহরণ দিয়ে বলছি, প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কিভাবে বৈষম্য ছড়িয়ে আছে। বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কত শতাংশ মুসলমান শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রয়েছেন? শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৩ থেকে ৪ শতাংশ। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বটা আরো করুণ। আরবি-ফারসির মতো কয়েকটা বিভাগ আছে বলে এখনো কয়েকজন মুসলমান শিক্ষক রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ১ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানও একটা বিষয়। আপনি দেখবেন, মুসলমানদের বসবাস সাধারণভাবে গ্রামীণ বাংলায়। মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলো হলো- মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বীরভূম, ২৪ পরগণার একটা বড় অংশ। দেখুন, এখানে কেমন বৈষম্যের চিত্র দেখা যায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্পায়ন এগুলো সবই কলকাতাকেন্দ্রিক, যা গড়ে উঠেছে কলকাতা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা শহরে থাকে; দলিত, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সাধারণত গ্রামে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সম্প্রতি মালদহে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। যেখানে দলিত, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আবাস; সেখানে একটা কাঠামোগত বৈষম্য রয়েছে। এ কথাগুলো আগে জনগণের মাঝে সেভাবে বলা হতো না। সাচার কমিটির প্রতিবেদন আসার পর এ বিতর্কগুলো জনগণের মাঝে কিছুটা পৌঁছেছে। আগে হয়ত মানুষ ডাইনিং টেবিলে এ নিয়ে আলাপ করত, সাচার কমিটির প্রতিবেদন ওই ডাইনিং টেবিলের আলাপ জনগণের মাঝে নিয়ে গেছে। 
সাচার কমিটির প্রতিবেদন শুধু সংখ্যালঘুদের বিষয়টিকেই নয়, এটি নতুন একটি আইডিয়া তৈরি করেছে- সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে না দেখে নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা। সব নাগরিকের সমান সুযোগ, সমান অধিকারের বিষয়টি এ কমিটি সামনে নিয়ে এসেছে। আগে মুসলিম রাজনীতি বলতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু স্ট্যাটাস, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ড, বাবরি মসজিদ- এ তিনটা ইস্যুকেই বোঝানো হতো। ৮০ বা ৯০-এর দশকে জাতীয় মুসলিম রাজনীতিতে এটাই ছিল মানদণ্ড। সাচার কমিটির প্রতিবেদন সেই মানদণ্ডকে ভেঙে দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ড, বাবরি মসজিদ মুসলমানদের মূল ইস্যু নয়। এর চেয়ে অনেক বড় ইস্যু হলো বৈষম্য বৃদ্ধি, আরও বড় ইস্যু হলো মুসলিম নারীদের স্বাস্থ্য সেবা, মুসলিম নারীদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের কথা, মুসলিম ছেলে-মেয়েদের পুষ্টির কথা। যে রাজনীতিটাকে আগে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা হতো, সাচার কমিটি সেটাকে একটা সামাজিক উন্নয়নের চোখে দেখতে সাহায্য করেছে। 
সাচার কমিটি আরেকটা কাজ করেছে- এতদিন তোষণের নামে যে রাজনীতির অভিযোগ উঠছিল, সাচার কমিটি সেটাকে খণ্ডন করেছে। ওই প্রতিবেদন বলছে, ‘তোষণ’ বলে এখানে যা চালানো হতো, সেটা তোষণ নয়, শোষণ। যার ফলে সাচার কমিটি কিছু সুপারিশও দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কারিগরি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা, স্কুল-কলেজ তৈরি করা, স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করা এবং মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য লেখাপড়ায় বৃত্তির ব্যবস্থা করা। 
মুসলিম সম্প্রদায়কে সাচার কমিটি তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। যাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মতোই, তারা আশরাফ। আজলাফ, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা হিন্দু নিম্নবর্ণের মতো- মুসলমানদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই বেশি। আরেকটা ক্যাটাগরি হলো আরজাল- যারা অচ্ছুত, দলিত থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন- পশ্চিমবঙ্গে তাদের সংখ্যা অন্য রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা আরও পিছিয়ে পড়ার একটা কারণ হলো- তারা শ্রেণিগত ও বর্ণগতভাবে একদম পিছিয়ে পড়া। পশ্চিমবঙ্গে আপনি মুসলিম কমিউনিটি থেকে আসা কোনো ভালো পত্রিকার একজন সম্পাদক, একজন ভালো তথ্যচিত্র নির্মাতা, বা একজন বিখ্যাত একাডেমিশিয়ান খুঁজে পাবেন না। এগুলো কেন হচ্ছে? কারণ কোনো সরকারই এ ইস্যুগুলোকে এড্রেস করেনি। আর যেটুকু এড্রেস করেছে, সেটা ওপর থেকে করেছে। কিন্তু মুসলিমরা প্রতিটা দিন যে ইস্যুগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা এড্রেস করেনি। 
এ সময়ে দাঁড়িয়ে সাচার কমিটির প্রতিবেদন এতটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই যে, এটি ধর্মের ভিত্তিতে পলিসি তৈরি করতে নিষেধ করেছে। পলিসি তৈরি করতে বলেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার ওপর নির্ভর করে। ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর ভিত্তি করে সাচার কমিটি ভারতীয় মুসলিমদের যে অবস্থা, তার পুরো পারসপেক্টিভটাই পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু এখন ভারতে এমন একটি দল ক্ষমতায় এসেছে, যাদের আইডিওলজিটা সংখ্যালঘু নিরাপত্তার ইস্যুটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যার ফলে রুটি-রুজির ইস্যুটা পেছনে চলে গেছে। সামাজিক ন্যায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন- এগুলো এখন ব্যাকফুটে চলে গেছে। এখন বেঁচে থাকার প্রশ্নটাই সামনে এসেছে। এখানে সেক্যুলার ও কমিউনাল- বাইনারির প্রশ্নটা সামনে আসছে। এর সমস্যাটা হলো- এখানে আর আপনার সামাজিক ন্যায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সরকারি চাকরি, বা জাতীয় অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের মতো প্রশ্নগুলো সামনে আসবে না। এখন লিঞ্চিং আর বেঁচে থাকার প্রশ্নটাই প্রধান। এটা দুই পক্ষের কাছেই সুবিধাজনক। যারা কমিউনাল গ্রুপ, তাদের জন্যও সুবিধা হয়, আবার যারা তথাকথিত সেক্যুলার গ্রুপ, তাদেরও সুবিধা এতে। কোনো পক্ষকেই সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন ডিল করতে হচ্ছে না। আর এই যাঁতাকলে ফেঁসে যায় একটা বড় সংখ্যক গরীব মুসলমানরা। তাই এখন কেউ দেখা হলে জিজ্ঞেস করছে- কেমন আছেন, শুনছি এখানে-ওখানে মেরে ফেলা হচ্ছে। 
মেরে ফেলার ঘটনাও কিন্তু নতুন নয়। লিঞ্চিংয়ের ঘটনাগুলো এখন হয়ত আধুনিকভাবে অনেক ব্যাপক অর্থে এসেছে। কিন্তু এটা এবারই প্রথম হচ্ছে না। ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর শেকড় রয়েছে বহু আগে থেকেই। ভারতে সেন্সাসে আপনি দেখবেন, প্রতি ঘণ্টায় সাত জন নারী ধর্ষিত হন। প্রতি আধ ঘণ্টায় একজন দলিত নিগৃহীত হন। এটা শুধু বিজেপি ক্ষমতায় আছে বলেই হয়নি। এটা আগেও হতো, এখনো হচ্ছে। একটা কথা আছে না- ‘সব পাখিই মাছ খায়, মাছরাঙার দোষ হয়’। এটা শুধু বিজেপির বিষয় নয়, এটা এ রাষ্ট্রের পুরো রাজনৈতিক কাঠামোর বিষয়। যার ফলে আদিবাসী, দলিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ওই কাঠামো দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। আপনি বাম ফ্রন্ট বলুন, কংগ্রেস বলুন, বিজেপি বলুন, তৃণমূল কংগ্রেস বলুন- তাদের সবার মূল চালিকাশক্তি কিন্তু উচ্চবর্ণ। তাদের কর্মী দলিত হতে পারে, কিন্তু তাদের পার্টির যে নীতি-নির্ধারক, তারা সবাই উচ্চবর্ণের। তার মানে, আপনি একটি উচ্চবর্ণের দলকে সরিয়ে অন্য একটি উচ্চবর্ণের দলকেই ক্ষমতায় বসাচ্ছেন। তাদের মাঝে কিছু তফাৎ আছে- কেউ খানিকটা গণতান্ত্রিক, কেউ কম গণতান্ত্রিক, কেউ গণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু র‌্যাডিক্যাল কোনো পরিবর্তন এর মধ্য দিয়ে হচ্ছে না। 

কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তন তো সম্ভব নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা রাজ্যে আমরা দেখলাম, ভারতের নির্বাচনে বাম ফ্রন্টের অনেক নেতা-কর্মীরাই বিজেপিকে সমর্থন দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি, বা হিন্দুত্ববাদের উত্থানের বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন? 
আবদুল মতিন: অনেকেই ভেবেছিল, বিজেপি হয়ত এতোটা আসন পাবে না। নির্বাচনে বিজেপি ১৮টা আসন পেয়েছে। তবে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) সেই এলাকাগুলোতেই জিতেছে, যেখানে মুসলিম ভোটারদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। তার মানে নির্বাচনে একটা পোলারাইজেশন হয়েছে। হিন্দুদের একটা বড় অংশ পোলারাইজড হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। আর মুসলিমদের আর কোনো অপশন ছিল না। কেউ কিন্তু ভালোবেসে ভোট দেয়নি টিএমসিকে। বামপন্থী যে নেতা-কর্মীরা ভোট দিয়েছে বিজেপিকে, তাদের প্রতি আমার একটা প্রশ্ন আছে- ভারতের নির্বাচনী গণতন্ত্রে ‘নোটা’ (‘না’ ভোট) বলে একটা অপশন আছে- যে আমার কাউকে পছন্দ নয়। কর্ণাটকের দুটি আদিবাসী অধ্যুষিত নির্বাচনী এলাকায় সবচেয়ে বেশি ‘না’ ভোট পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তো একটা উদাহরণ তৈরি করতে পারতো- তা হয়নি কেন? তৃণমূলকে জব্দ করতে বিজেপিকে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে- কিন্তু বিজেপি দিয়ে তৃণমূল জব্দ হয় না। তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। টিএমসিও এক ধরনের হিন্দুত্ব পলিটিকস করে, কিন্তু দুটি হিন্দুত্বের মধ্যে একটু তফাৎ আছে। অনেকেই দুটি দলকে এক করে ফেলেছেন। 
পশ্চিমবঙ্গে এখন যে ভয়ঙ্কর হিন্দুত্বের আবহ তৈরি হয়েছে, সেটা আমরা গুজরাট, উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রে ভাবতাম। সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু অনেক ভিন্ন। আবার বাংলা কিন্তু হিন্দুত্ব ফিলোসফির জন্মদাতা। পশ্চিমবঙ্গে এক ধরনের ‘সাইলেন্ট কমিউনালিজম’ অপারেট করে। এ ‘সাইলেন্ট কমিউনালিজম’ এতদিন রাজনৈতিক হাওয়া পায়নি। এটা তখনই হয়, যখন একটা বড় সংখ্যক মুসলিম টেক্কা দিতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গে তো সেটা নেই, পশ্চিমবঙ্গে শ্রেণি ও বর্ণ অনুসারে মুসলিমরা মার্জিনাল ক্লাস, ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটি। তারা কখনোই বর্ণহিন্দুদের কাছে থ্রেট ছিল না। গত দশ বছরে উচ্চশিক্ষায় আসার ফলে মুসলিম কমিউনিটিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এখন ‘দিনদর্পণ’, ‘কলম’ বলে কিছু ছোট ছোট পত্রিকা চলে পশ্চিমবঙ্গে। এ পত্রিকাগুলো ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা থেকেই আসা। এর একটা লেজিটিম্যাসি পাচ্ছে মুসলিম কমিউনিটি। কারণ, যে স্টাবলিশড সংবাদপত্রগুলো আছে, তারা কিন্তু মুসলিমদের খবর ছাপতো না। এত বড় একটা ঈদ হয়- রাজ্যের ২৭ শতাংশ মানুষের কাছে যা একটা বিরাট অনুষ্ঠান, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়- সেখানে ঈদের পরদিন সংবাদপত্রে ঈদের খবর হয়- এক কলামে ছোট্ট একটা ছেলে বা মেয়ের ছবি দিয়ে নিচে লেখা- ‘শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ পালিত হলো’। শুধু মুসলিম নয়, দলিত, আদিবাসীদেরও বাদ দিয়ে দেয়। যা-ই হোক, ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা এখন কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে তাদের কথাটা বলছে, তারাই নিজেদের ঈদ সংখ্যা বের করছে, তারা নিজস্ব একটা পার্সপেক্টিভ রাখছে। আর এটাকেই থ্রেট বলে চালানো হচ্ছে- এবার হয়ত মুসলিমরা রাজ্যটা দখল করে নেবে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মমতাজ বেগম’ বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গে গত পঞ্চাশ বছরে সমাজ সংস্কার হয়নি। আমরা এখনো বলি রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্রদের কথা। কিন্তু ওটা তো অনেক সময় পার হয়ে গেছে। উপনিবেশ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সমাজ সংস্কারের এজেন্ডা কোনো রাজনৈতিক দলও নেয়নি, কোনো সামাজিক সংগঠনও নেয়নি। 
তবে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর যেটা হয়েছে, তা হলো- বাম আমলে ‘মুসলিম’ শব্দটাই আলোচিত হতো না। এখন অন্তত এটা পাবলিকলি আলোচিত হচ্ছে। তিনি একদিকে হিন্দুত্ব পলিটিকসও করেছেন। আবার প্রগ্রেসিভ র‌্যাশনাল মুসলিম কমিউনিটিকে না দেখে একটা কনজারভেটিভ মুসলিম গ্রুপকে প্রণোদনা দিয়েছেন। যার ফলে মুসলিম কমিউনিটির প্রগতিশীল অংশটা- যারা গণতান্ত্রিক ভাষায় কথা বলতে পারবে, সমঅধিকারের পক্ষে কথা বলতে পারবে- সেই কথাগুলো হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মুসলিম কমিউনিটির এ সমস্যাগুলো এবং সমান অধিকারের প্রশ্নে কোনো উদ্যোগ বা আন্দোলন আছে কী? 
আবদুল মতিন: বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এখনো সেভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আসতে পারেনি। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কিছুটা এসব নিয়ে কাজ করেছেন। সন্তোষ রাণার মতো সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা কিছু কাজ করেছেন। গণতান্ত্রিক ও অধিকার সংগঠনগুলো সাচার কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে অনেক জায়গায় প্রোগ্রাম করেছে। এগুলো সেমিনার এবং প্রতিবেদনের আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এটা গণ-আন্দোলন বা পপুলার আন্দোলনে আসেনি। এক ধরনের আড্ডায় চর্চা হয়েছে, কিন্তু এর বাইরে আসেনি। এর জন্য দরকার পরস্পরকে জানা। গত পঞ্চাশ বছরে এত বেশি বিচ্ছিন্নতা এসেছে যে, বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি সম্পর্কেই অন্যরা জানতে পারছে না।

গুজরাটে একজন জিগনেশ মেভানি উঠে আসতে পারলে, পশ্চিমবঙ্গে কেন এমনটা হচ্ছে না?
আবদুল মতিন: একদম। এটা খুবই বড় প্রশ্ন। গুজরাটে যে কাস্ট পলিটিকস হয় স্থূলভাবে, পশ্চিমবঙ্গে সেটা হয় সুক্ষ্মভাবে। পশ্চিমবঙ্গে যদি র‌্যাডিক্যাল কাস্ট পলিটিকস থাকত, তাহলে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও মেভানি উঠে আসত। কারণ পশ্চিমবঙ্গে আম্বেদকার রুটস আছে। আম্বেদকার জিতেছিলেন বাংলায়। বাংলার পার্টিশনের ফলে দলিত ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এক ধরনের নাই হয়ে গিয়েছে। এখনো সেভাবে দলিত ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীতার উত্থান ঘটেনি। এ কারণেই পপুলার মুভমেন্টে মুসলিমদের রুটি-রুজি বা অধিকারের প্রশ্নটা সেভাবে উঠে আসতে পারেনি। এখনো মুসলিমরা ‘মুসলিম’ হয়েই আছে। তাদের ইস্যুগুলোকে ধর্মের আবহে দেখা হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষার অধিকারের জায়গা থেকে দেখা হয় না।

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকায় প্রকাশিত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //