ভিটো কর্লিওনি; সেই মানুষটি মার্লোন ব্র্যান্ডো

একটা সময় ছিল যখন বায়োস্কোপ বলতে এদেশের মানুষ আনন্দে নেচে উঠতো। বিনোদনের জন্য সব সময় বায়োস্কোপ দেখা ছিল একটা দারুণ আনন্দের ব্যাপার। সেই সময়ের কথা বলছি যখন এদেশে উর্দু সিনেমার চল ছিল, এখানে ‘মুখ ও মুখোশ’ তৈরি হয়ে গেছে- বাঙালির প্রথম চলচ্চিত্র। তবুও উর্দু-হিন্দি চলচ্চিত্রেরও জাঁকজমক এক প্রভাব ছিল। এ ছাড়া চলত হলিউডের কিছু চলচ্চিত্র। কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রও তখন এদেশে দেখা হতো সময়টা এমন। 

ঠিক এর বছর কয়েক পরের কথা বলছি- আমেরিকান চলচ্চিত্রের জগৎ কাঁপানো এক নায়ক মার্লোন ব্র্যান্ডো। তার নিজের ব্যবহারের কারণে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ছিটকে পড়েছেন। কেউ তাকে আর চলচ্চিত্রে নিতে চায় না। প্রযোজকরা তার নাম শুনলে ঘেন্না করেন। অথচ এই মার্লোন এক যুদ্ধফেরত যুবকের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আবির্ভূত হন ‘দ্য ম্যান’ নামক চলচ্চিত্রে।

১৯৫০ সালে হলিউডে মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রটি। ছবিটি মুক্তির পর সমালোচকরা নবীন অভিনেতা মার্লোনকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন। এরপর তিনি তার ব্রডওয়ে অভিনীত নাটক ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এর চলচ্চিত্র সংস্করণে অভিনয় করেন। এতে তিনি প্রধান চরিত্র স্ট্যানলি কোয়ালস্কির ভূমিকায় অভিনয় করেন। অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রতিভার পরিপক্বতা দেখান। তখন তাকে নিয়ে চারদিকে সরগরম অবস্থা। পরিচালকেরা তাকে তাদের সবার চলচ্চিত্রে নিয়ে নিতে পারলে যেন জয়ী হবেন এমন ছিল। কিন্তু মার্লোন ব্র্যান্ডো অতিমাত্রায় বাজে ব্যবহার করতেন। অথচ খ্যাতির দুনিয়ায় তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। সে সময়ে তিনিই ছিলেন সেরা।

নিখুঁত অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত এই অভিনেতা ‘মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি’তে অভিনয় করেন। কিন্তু তার বিশৃঙ্খল জীবনযাপন এই চলচ্চিত্রের দফারফা করে একবারে ১২টা বাজিয়ে দিয়েছিল। ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে ব্যাপক ভরাডুবির মুখে পড়ে। এরপর আর বাকি দশকজুড়ে তিনি এতটুকুন সফলতার মুখ দেখেননি। যারা এক সময়ে তাকে সম্মান করত, ভালোবাসত তারাই তাকে দূরে ঠেলে দেয়। তার আর যাওয়ার কোথাও জায়গা রইল না সে সময়। বাধ্য হয়ে আরও বিশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন, রীতিমতো গৃহীর জীবন।

বহুদিন ধরে তিনি পরিচালকদের অবহেলা, অপমান আর সমালোচনার মাঝে পড়ে দূরে সরে গেছেন অনেকখানি, যেন নিজের ভেতর বুঁদ হয়ে থাকা তার একান্ত সে জগৎ। তাকে নিয়ে আর কারও আশা নেই সেইজন্য তার ডাক পড়েও না কোনো চলচ্চিত্রে। কোথাও কোনো উপায় না পেয়ে ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা মার্লোন ব্র্যান্ডোকে নিতে চাইলেন। কিন্তু প্রযোজকের দল তাতে রাজি হলেন না, তারা শর্ত দিলেন ফ্রান্সিসকে। মার্লোনকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার।

এক মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করালেন পরিচালককে দিয়ে- যাতে মার্লোনের পাগলামোর কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হন। এবং শেষ কথা ছিল তাকে অডিশন দিয়েই প্রমাণ করতে হবে তিনি যোগ্য। সব শর্ত মেনেই নিলেন অবশেষে পরিচালক। এরপর পরিচালক পৌঁছলেন গিয়ে মার্লোন ব্র্যান্ডোর দরোজায়। দরোজা খুলতেই সোনালি চুলের মার্লোনকে দেখে পরিচালক ফ্রান্সিস খুশিই হলেন- এ যে ‘ভিটো কর্লিওনি’! যাকে তিনি এতকাল খুঁজছেন। তারপর চলল দু’জনের কথা। এরপর মার্লোন ব্র্যান্ডো প্রযোজকদের শর্ত মোতাবেক সব মেনে নিয়ে একে একে উত্তীর্ণ হলেন। 

১৯২৪ সালের ৩ এপ্রিল জন্ম হয় যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কার ওমাহায় খ্যাতিমান এই অভিনেতার। তার পিতার নামও মার্লোন ব্র্যান্ডো হওয়ায় তাকে মার্লোন ব্র্যান্ডো জুনিয়র হিসেবে ডাকা হতো বাইরে। তার পিতা ছিলেন একজন দোকানি এবং মা স্থানীয় নাট্য মঞ্চে শখের বশে অভিনয় করতেন মাঝে মাঝে। পারিবারিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না তারা আর পিতা-মাতা দু’জনেই ছিলেন মদ্যপ।

পরিবারে তিনি এমন ঝগড়া বিবাদ দেখে দেখে নিজেও রগচটা স্বভাবের হয়ে ওঠেন। ফলে বাল্যকালে বিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়শই তিনি মারধর করতেন, ঝগড়া বিবাদে তার ছিল না ক্লান্তি। ফলে তার নামে নালিশ আসতো, বাবার ধমক আর বকার মাঝে তার একমাত্র স্নেহের ক্রোড় ছিল বড় বোন। শিশু মার্লোন তাই সব কিছুর বাইরে বোনের কাছেই নিরাপদ বোধ করতেন।

একসময়ের পারিবারিক এমন বিগড়ানো অবস্থার কারণেই হয়তো মার্লোন যখন খ্যাতি অর্জন করেন তখন সবার সাথে দুর্ব্যবহার করতেন। পত্রিকাঅলারা তাই বুঝি তাকে ‘ব্যাডবয়’ নামেই ডাকতেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা চলচ্চিত্র জগতের মোজার্ট কিংবা বেটোফেনতুল্য এই মার্লোন ব্র্যান্ডো আজও অদ্বিতীয় অতুলনীয় চলচ্চিত্র দুনিয়ায়। চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে বড় পুরস্কার অস্কার নিতে অস্বীকার করেন- কেননা তৎকালিন সরকার রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করতেন।

মার্লোন ব্র্যান্ডো কখনো পুরস্কারের তোয়াক্কা করেননি। তার জীবদ্দশায় তিনি মোট আটবার অস্কারের জন্য মনোনয়ন পান এবং দুইবার তা জিতেছিলেন। তিনি নারীপ্রেমী আর মদপ্রিয় ছিলেন। ফলে তার জীবনে স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তিই ছিল বেশি। কেননা- মদ্যপ হয়ে তিনি সকলের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন যা তার মর্যাদাকে বরাবরই কমিয়েছে। শেষজীবনে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলার কারণে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পায় তার।

ব্যক্তিগত জীবনে নানাভাবে ব্যর্থতার শিকার হওয়া এই জগৎখ্যাত অভিনেতা ২০০৪ সালের ১ জুলাই লস এঞ্জেলসের একটি হাসপাতালে মারা যান ৮০ বছর বয়সে। দুনিয়াজুড়ে মার্লোনপ্রেমীরা আজও তাকে স্মরণ করেন- আর বিমুগ্ধ নয়নে দেখেন তার অভিনয় করা চলচ্চিত্রগুলো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //