নীলমণি ফুকন অসমীয়া ভাষার একজন ভারতীয় কবি, শিল্পী,সমালোচক এবং অধ্যাপক। তিনি ১৯৩৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অসমের দেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৫০ সালের সূচনাপর্ব থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। তার কাজ ছিল প্রতীকীবাদে পরিপূর্ণ, যা অসমীয় কাব্য ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি ফ্রেঞ্চ প্রতীকীবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ‘সূর্য হেনো নামি আহে এই নদীয়েদি’, ‘গুলাপী জামুর লগ্ন’এবং ‘অন্যান্য কবিতা’-প্রভৃতি তার অন্যতম অবিস্মরণীয় কীর্তি। তার পূর্বগামী ব্যক্তিগণ, হেম বড়ুয়া, অমূল্য বড়ুয়া এবং মহেশ্বর নিয়োগ দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং অসমীয় আধুনিকতার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং এর সম্ভাব্য বিস্তৃতির উদ্দ্যেশে অন্যান্য সমসাময়িক প্রতিভাবান সৃজনী নবকান্ত বড়ুয়া এবং অজিত বড়ুয়ার থেকে তিনি মুক্ত ছন্দ নিতেন।
তিনি ১৩ খণ্ড কাব্যগাঁথা রচনা করেছিলেন এবং ১৯৮১ সালে কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য একাদেমিসহ দশটি প্রাদেশিক এবং জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।
তিনি তার কাব্যে- আবেগ বনাম অশ্রু, গ্রহ ও নক্ষত্র,সবুজ বনাম মরুভূমি,মানুষ বনাম পাথর, সময় বনাম ব্যবধান, যুদ্ধ বনাম শান্ত, জীবন বনাম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বর্তমান সমাজের একটি সুস্পষ্ট চিত্র পাঠকবর্গের কাছে তুলে ধরেছেন।
১৯৬৪ সালে তিনি গৌহাটির আর্য বিদ্যাপীঠ মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে তার অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি সেখানে অধ্যাপনা করেছিলেন। নীলমণি ফুকন রচিত এই পাঁচটি কবিতা ভাষান্তর করেছেন- সুদেষ্ণা ঘোষ
জিজ্ঞাসা করোনা, কেমন আছি?
জিজ্ঞাসা করোনা, কেমন আছি?
কলং-এর নীচ থেকে ভেসে এসেছে
একটি মস্তিষ্কহীন বালিকা
আমার শবদেহের জন্য
বিয়াল্লিশ ঘণ্টা যাবৎ শায়িত ছিল
গৌহাটির ফুটপাতে
তখনো আমি চোখ মেলে ছিলাম
মৃত্যুও তার চোখ দুটি মেলে ছিল
খাদগুলো-কর্দমাক্ত ক্ষুদ্র জলাশয়গুলো-হ্রদগুলোতে
মাছের ঝাঁক দ্রুতবেগে বলল-
ওহ, আমার স্বাচ্ছন্দ্য গতি সম্পন্ন অশ্বারোহীরা।
বিবর্ণতার গান
জঙ্গলে- গভীর জঙ্গলের মধ্যে
একটি সারস পাখি ডাকছে।
তোমার বাহুযুগল মুক্ত কর
নক্ষত্রদের ঝাঁক ডুবে যেতে দাও
তোমার কেশরাশির সৌরভে
দীঘিটা জলপদ্মে পরিপূর্ণ
বাতাস শোঁ শোঁ- শব্দে বইছে
তোমার দেহের গভীরে
প্রস্ফুটিত একটি লাল কুঁড়ি
বৃষ্টি স্রোতের মতোই প্রবাহিত-
উন্মুক্ত পত্রবৎ অঙ্গ
তোমার স্তনযুগল থেকে ক্ষরিত রক্ত
তোমার ওষ্ঠদ্বয় চুঁইয়ে বাহিত হয়েছে।
এখন তুমি জাগ্রত
অন্ধকার মুখমন্ডলটি উজ্জ্বল
মেঘরাশি পাহাড়ের ওপরে গুড়গুড় শব্দ করে।
কবিতা তাদের জন্য যারা ইহা পড়েনি
একজন কবি বর্ণনা করেছিলেন:
কবিতা তাদের জন্য যারা ইহা পড়েনি
তাদের হৃদয়ের ক্ষতগুলোর জন্য
তাদের আঙ্গুলগুলোর জন্য- যেখানে কাঁটাগুলো দৃঢ়ভাবে বিদ্ধ
বেদনা এবং আনন্দের জন্য
যা জীবন-মৃত্যু থেকে উদ্ভূত
চিৎকারটির জন্য, যেটি চাকার মতোই
দিবারাত্রি রাস্তায় গড়িয়ে চলে
মরুভূমির সূর্য্যরে জন্য
মৃত্যুর অর্থ
এবং জীবনকালের শূন্যতার জন্য
ধ্বংসের ফলে গুঁড়ো হওয়া কৃষ্ণাভ পাথরগুলোর জন্য
তরুণীদের কামাতুর ঠোঁটের মাঝে রক্তাভ দাগের জন্য
কাঁটা তাদের ওপর ডানা ছড়ানো হলুদ প্রজাপতিদের জন্য
পতঙ্গ, শামুক এবং শৈবালদের জন্য
পড়ন্ত বিকেলের আকাশে উড়ন্ত নিঃসঙ্গ পাখিটির জন্য
আবেগ এবং অশ্রু নিমজ্জিত উদ্বিগ্নতার জন্য
পঞ্চাশ কোটি রুগ্ন এবং অন্নহীন শিশুদের মায়ের জন্য
চাঁদটির রক্তের মতো লালরঙা পরিবর্তনের ভয়ের জন্য
প্রত্যেকটি স্থির মুহূর্তের জন্য
পরিবর্তনশীল পৃথিবীর জন্য
তোমার নিকট থেকে একটি চুম্বনের জন্য
ধুলোর মানুষটি পুনরায় ধুলোতে পরিণত হবে,
এই পুরনো কথাগুলোর জন্য।
ওই দিনটি ছিল রবিবার
ওই দিনটি ছিল রবিবার-
কসাইখানা থেকে তাজা রক্তনদী প্রবাহিত হয়েছিল
রাস্তা বেঁয়ে পাশের পয়োঃনালীতে
আবেগপ্রবণ পথিকরা খেয়াল করেনি
এই রক্ত নদীটিকে-
একজোড়া অযোগ্য সারমেয় লেজগুটিয়ে
তরল লাল রঞ্জক লেহন করছিল
অস্থির মানুষদের মুখমন্ডলগুলো
ফাঁপা করোটির মতো দেখাচ্ছিল
শবাগার থেকে জাগ্রত মানুষটির সংরক্ষিত আর্তনাদ
দূরাভাষের তারের মাধ্যমে নিচে নেমে এসেছে
যেখানে একজোড়া চড়ুই অলস সময় কাটাচ্ছিল
ওই দিনটি ছিল রবিবার-
বাজার কমলালেবুতে প্লাবিত
বিক্রি সম্পন্ন হবার পূর্বেই
অন্য আরেকটি রবিবার শুরু হয়েছিল।
আকাশ কাঁপছে
আকাশ কাঁপছে, আমি আলোর জন্য হাতড়াচ্ছি
তারমধ্যে হঠাৎই রক্ত মাংসে
আমার মা-
তার চোখে আলোর শিখা, মুখমন্ডলের রক্তাক্ত- আমি চিৎকার করলাম-
‘মা, মাতৃভূমি’
গাছের পাতার মধ্য দিয়ে অতিক্রমনকালে, সবুজের মধ্যে দিয়ে দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে
তুমি আমর মেঘপৃষ্ঠের ওপর লুকিয়ে থাকা রোদ্দুর
আমি তোমাকে প্রত্যেকটা বৃষ্টিফোঁটায় সিক্ত হতে দেখি
যেন কোথাও ধান বপন করতে এসে রক্তের বীজ বুনেছো
রামধনু উড়ে আসে তোমার একপলক দৃষ্টির সঙ্গে-
শারদীয় মাঠগুলোতে আন্দোলিত হয়
আমার আদুরে মা
আমার হৃদয়ে বাহিত মুক্ত হলদে বাতাস।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : নীলমণি ফুকন-এর কবিতা কবিতা
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh