মহানায়ক জাফর ইকবালের প্রয়াণের ২৮ তম বর্ষ

নতুন প্রজন্মের অনেক দর্শকের কাছেই তার নামটি অজানা। সংগীতে প্রতিষ্ঠা পেতে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছিলো তাকে। তারপর এলেন চলচ্চিত্রে। এখানেও তীব্র প্রতিযোগিতার ভিড়ে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার ডাক শুনে অস্ত্র হাতে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধেও। জীবন তার অনেক সংগ্রামের রঙে রঙিন। কিন্তু আফসোসের বিষয়, যখনই ঢাকাই সিনেমার আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলে উঠলেন তখনই মৃত্যু কেড়ে নিল সব আলো। এতক্ষণ ধরে বলছিলাম চিরসবুজ চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের কথা। 

ঢাকাই ছবিতে জাফর ইকবাল ছিলেন সত্তর ও আশির দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় হার্টথ্রব নায়ক। বিশেষ করে রোমান্টিক দৃশ্যে তার উপস্থিতি নাড়িয়ে যেত তরুণীদের হৃদয়। তাকে স্টাইল আইকন হিসেবে নিয়েছিলেন সে সময়ের তরুণরা। এমনকি তার পরবর্তী জেনারেশনের নায়করাও তার ফ্যাশন অনুসরণ করেছেন।

তাকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করে খুব সহজেই লাভবান হতেন পরিচালক ও প্রযোজকরা। অথচ সময়ের স্রোতে জাফর ইকবাল ভেসে গেলেন দুর্বল স্মৃতির ঢেউয়ে। তার জন্মদিন, মৃত্যুদিন চলে যায় নীরবে, মনে রাখে না কেউ। না ফেরার দেশে বসে অকৃতজ্ঞ চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি, কাজের সহকর্মী আর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হয়তো নিজের গাওয়া গানটিই বেশি করে মনে পড়ে তার- ‘আমি তো এখন আর নই কারো’!

জাফর ইকবাল জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে। বাড়িতে গানবাজনার রেওয়াজ ছিল। তার বোন শাহানাজ রহমতুল্লাহ একজন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজও নামকরা সংগীত পরিচালক। ভাই ও বোনের মতো জাফর ইকবালও প্রথমে গায়ক হিসেবেই পরিচিতি পান। স্কুল, ক্লাবের কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই গিটার বাজিয়ে গান গাইতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি নিজের একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন। ‘পিচঢালা পথ’ সিনেমায় তিনি প্রথম গান করেন। ‘বদনাম’ ছবিতে তার কণ্ঠে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে অমর সৃষ্টি হয়ে আছে। 

চলচ্চিত্রের বাইরে তার গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘যেভাবে বাঁচি, বেঁচে তো আছি’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি রুনা লায়লার সঙ্গে ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’ গানটিতে কণ্ঠ দেন। জাফর ইকবাল আমৃত্যু একজন গায়ক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আনন্দবোধ করেছেন।

স্বাধীনতা অর্জনের পরে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। ‘সূর্যসংগ্রাম’ ও এর সিকুয়াল ‘সূর্যস্বাধীন’ চলচ্চিত্রে ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে ‘মাস্তান’ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় তাকে সে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ। সামাজিক প্রেমকাহিনী ‘মাস্তান’র নায়ক জাফর ইকবাল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান।

‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এক গ্রামীণ তরুণের চরিত্রেও দর্শক তাকে গ্রহণ করে। নায়ক এবং গায়ক হিসেবে তিনি ক্রমেই নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলেন। জাফর ইকবালের সাথে অভিনেত্রী ববিতা জুটি হয়ে প্রায় ৩০টির মতো ছবি করেন।

সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ১৫০টি ছবি করেন। যার মাঝে আপন পর, সাধারণ মেয়ে, ফেরারি, মাস্তান, দিনের পর দিন, সূর্য সংগ্রাম, বেদ্বীন, অবদান, আর্শীবাদ, মিস লংকা, বদনাম, ভাইবন্ধু, অবুঝ হৃদয়, নয়নের আলো, এক মুঠো ভাত, যোগাযোগ উল্লেখযোগ্য।

এসএসসি পাস করার আগেই তিনি গিটার বাজাতেন। গিটারে ইংরেজি গান তুলতেন। এলভিস প্রিসলি ছিল তার বড়ই প্রিয় তারকা। স্কুলে কোনো ফাংশন হলে তিনি গিটার বাজিয়ে এলভিস প্রিসলির গান গাইতেন। অভিনয়ের চেয়ে তিনি প্রেমিক-পুরুষ হিসেবে নামধাম করেছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে। জাফর ইকবাল আর ববিতা জুটি হিসেবে ঝড় তুলতে না তুলতেই এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। মন দেয়া-নেয়ার কথাও তখনকার সিনে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। এ ছবিতে চম্পা ও ববিতা- দুই বোনের বিপরীতে তার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ববিতার সঙ্গে তার জুটি ছিল দর্শক নন্দিত। এই জুটির বাস্তব জীবনে প্রেম চলছে বলেও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় হতাশ হয়েই জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান বলে জোর গুঞ্জন উঠেছিল। ববিতার বিপরীতে ৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

জনপ্রিয় নায়িকা ববিতার ভাষায় (২০১৬), ‘নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আমার স্বপ্নের বা পছন্দের নায়ক ছিলো জাফর ইকবাল। কারণ তার কিছু জিনিস আমাকে একটু বেশিই মুগ্ধ করতো। তিনি যেমন সুদর্শন ছিলেন, তেমনি অভিনয়ে ছিলেন স্বাবলীল। তার কণ্ঠ, ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন সচেতনতা, রুচিবোধ ছিল অসাধারণ। তিনি খুব ভালো ইংরেজি গান গাইতে পারতেন। গিটার বাজিয়ে তার মুখে ইংরেজি গান শোনাটা আমাদের সময়কার যে কোনো মেয়ের জন্য ছিল স্বপ্নের মতো। আমি বলবো তার মতো সম্পূর্ণ কোনো নায়ক আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আসেনি। এক কথায় যাকে বলে সব্যসাচী। তার অকাল মৃত্যু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করেছে।’

জাফর ইকবাল ছিলেন একাধারে গিটার বাদক এবং গায়ক। তার কণ্ঠের স্বকীয়তা ছিলো অনন্য। তিনি ১৯৬৬ সালে প্রথম একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান ‘পিচ ঢালা পথ’। এই গানটি বহুদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এখনও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। জাফর ইকবাল এর কণ্ঠে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গানটি একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সুদর্শন, অভিনয় দক্ষতা, পোশাকে স্মার্ট স্টাইলের উপস্থিতি ছিল অসাধারণ। এই কারণগুলোই তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। আর পর্দায় তার অভিনয় এবং বিশেষ পর্দায় তার স্মার্ট উপস্থাপন তরুণদের কাছে তাকে করেছিল সর্বাধিক প্রিয়।

এছাড়া ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী’, ‘যেভাবে বাঁচি বেঁচে তো আছি’, ‘বিদেশ ঘুরে বাড়ি এলে’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ চিরসবুজ গান হিসেবে যে কোনো বয়সী আজও সমানভাবে শ্রোতাকে স্পর্শ করে যায়।

পরিবারের সাথে সিনেমাহলে ছবি দেখতে যাওয়ায় সেই শিশু বয়সেই অভিনেতা জাফর ইকবালের সাথে আমার পরিচয় হয়। যতদূর মনে পড়ে জাফর ইকবাল কে আমি প্রথম দেখি প্রয়াত দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ‘ ছবিতে। যে ছবির গানগুলো ছিল দারুণ। তখন এতো কিছু বুঝতাম না।

ধীরে ধীরে জাফর ইকবালকে আরো দেখতে থাকি এবং মুগ্ধ হই। আমার কাছে জাফর ইকবাল মানে কালজয়ী অনেক গানে অভিনয় করা প্রিয় একটি মুখ। সেই আশির দশকেই দেখেছিলাম প্রয়াত বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো‘ ছবিটি। সেই ছবিতে গ্রামের একজন বাউলের ছেলে বাউল শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। একঘরে করে দেয়া অসুস্থ মায়ের পাশে বসে গেয়েছিলেন ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি/এই চোখ দুটো তুমি খেয়ো না‘ গানটি। যা আজো বাংলার গানপাগল মানুষের মুখে মুখে।

এরপর জাফর ইকবালকে দেখেছি আরো অনেক রূপে, অনেক ছবিতে। কখনো প্রেমিক, কখনো পুলিশ অফিসার, কখনো মাস্তান, কখনো পিতৃহত্যার প্রতিশোধ পরায়ণ এক সন্তান, কখনো ডাক্তার, কখনো ভিখারি, কখনো গায়ক রূপে। জাফর ইকবালকে আমার ব্যক্তিগতভাবে যেসব ছবিতে বেশি ভালো লেগেছে সেগুলো হলো আশীর্বাদ, বেদ্বীন, মিসলংকা, আদেশ, ওগো বিদেশিনী, সিআইডি, অপেক্ষা, উছিলা, অবদান, ভাইবন্ধু, প্রতিরোধ, যোগাযোগ, অবুঝ হৃদয়, গর্জন, চোরের বউ, গৃহলক্ষ্মী, লক্ষ্মীর সংসার ও সন্ত্রাস, বন্ধু আমার ছবিগুলো।

আদেশ , ভাইবন্ধু ছবিতে কাঞ্চনের সাথে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। বিশেষ করে ভাইবন্ধু ছবিতে অন্ধ ভিখারি থেকে পর্দার আড়ালে থাকা একগায়কের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেন। অপেক্ষা ছবিতে মায়ের আদর বঞ্চিত থাকা পিতার কাছে বড় হওয়া এক যুবক যাকে ছোট বেলায় তার বাবা আলমগীর ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা শাবানার কাছ থেকে রাতের আঁধারে চুরি করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। গর্জন ছবিতে প্রথমে শহরের নাম করা মাস্তান যুবক, যে পরবর্তীতে একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে জীবন শুরু করে। মাস্তান ও পুলিশ অফিসার দুটো চরিত্রেই জাফর ছিলেন সফল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছবিতে সুচরিতার সাথে ‘জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান’ গানটির পর দর্শকরা মনে করেছিল জাফর ইকবাল বুঝি মোহামেডানের সমর্থক।

তিনি ছিলেন বেশ খামখেয়ালি, আবেগপ্রবণ এবং দারুণ অভিমানী। অনিয়মিত জীবনযাপন ও অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তার হৃদযন্ত্র ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাফর ইকবালের ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগণে, তখন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৯১ সালে ২৭ এপ্রিল মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই থেমে গেল ঢাকাই চলচ্চিত্রের রূপকথার যুবরাজের গল্প। 

মৃত্যুর আগে তার জীবিতঅবস্থায় শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘‘লক্ষ্মীর সংসার’’ যে ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল জাফর ইকবাল গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে নতুন এসেছেন এবং ঢাকার আজিমপুর যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন। ছবিটি মুক্তির এক মাসের মাথায় জাফর ইকবাল মৃত্যুবরণ করেন এবং আজিমপুরে গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হোন যা নিয়তির এক নির্মম পরিহাস। সেই সময় শেষ ছবিতে ‘ভাই আজিমপুর যাবো কিভাবে’ সংলাপটি ভক্তদের খুব কাঁদিয়েছিল। জাফর ইকবাল চলে গেছেন আজ দুই যুগেরও বেশি হয়েছে কিন্তু নতুন আরেকজন জাফর ইকবাল আমাদের চলচ্চিত্রে আর আসেনি এবং হয়তো আসবেও না। একজন গায়ক, নায়ক জাফর ইকবালের জন্য আমাদের আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানি না। জাফর ইকবাল বেঁচে থাকবেন তার অভিনীত ছবিগুলোর জন্য চিরকাল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : জাফর ইকবাল

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //