ঢাকার জলাবদ্ধতা গড়াবে কোথায়

চারশ’ বছর ধরে ঢাকাকে গড়তে হাজারে হাজার প্রকল্প। বছরজুড়েই চলে উন্নয়নযজ্ঞ! অথচ এ শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ প্রায় সব অবকাঠামোই অপরিকল্পিতভাবে তৈরি। ঘোড়ার আগে গাড়িজুড়ে দেয়ার মতো নগরায়ণের সর্বক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার যে ছাপ, তার খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকেই।

ফলে তপ্ত এই শহরে বৃষ্টি যতটা না আশীর্বাদ, তার চেয়ে বেশি অভিশাপ হয়েই ঝরে। সামান্যতেই জলাশয়ের রূপ নেয় মহাসড়কগুলো। তৈরি হয় তীব্র যানজট। মূলত পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকার কারণেই উৎকণ্ঠা আর দুর্ভাবনায় থাকতে হয় ব্যস্ত এ শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষকে। 

ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা আছে ঢাকার- দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো এমন দাবি করলেও ২০ থেকে ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই  বিভিন্ন সড়কে জমে যায় হাঁটু পানি। কেবল খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিপত্তিই নয়, ভয়াবহ জলাবদ্ধতার পেছনে রয়েছে আরো শত শত কারণ।

প্রতি বছরই দেয়া হয় আশ্বাস; কিন্তু বদলায় না বাস্তবতা। অস্বস্তি আর ভোগান্তিতেই রাজ্যের ক্লান্তি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলতে হয় পথে। অথচ ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণগুলো রহস্যঘেরা নয়। স্পষ্ট হলেও এর সমাধানে নেই যথাযথ উদ্যোগ। অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সংস্কারের নামে বর্ষার আগে আগে চলে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব! প্রতিনিয়ত যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে পলিথিনসহ নানা

ময়লা আবর্জনা। কঠিন বর্জ্যরে একটি অংশ ড্রেনে গিয়ে আটকাচ্ছে পানির প্রবাহ। 

এক সময় ঢাকার বুকে জেগে ছিল ৬৫টি খাল। সেগুলোও আজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। শুধু তা-ই নয়; বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগের মতো নদীগুলোও দখল হয়ে যাচ্ছে। অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে ভূমিদস্যু আর প্রভাবশালী দখলদাররা। ফলে বন্ধ হচ্ছে নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রধান পথগুলো। এ ব্যাপারে নেয়া উদ্যোগগুলোও কাজে আসে না বেশিরভাগ সময়। স্বল্প মেয়াদি নতুন আতঙ্ক হিসেবে যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প।

গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ভয়াবহ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে ঢাকাবাসীকে। এ বিষয়ে দিয়াবাড়ী এলাকার জাহিদ হাসান বলেন, ‘আমরা যেখানে বসবাস করি, এখানে কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। গত কয়েক দিন ধরে পানিতে আটকে আছি। মনে হচ্ছে আমরা ঢাকার মধ্যেই আরেকটি যমুনা নদীর তীরে বন্যাকবলিত ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাস করছি।’

অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট

ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজউক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণ করে ৩৮৫ কিলোমিটার বড় আকৃতির নালা, ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে খাল ও চারটি স্থায়ী পাম্পস্টেশন। 

দুই হাজার ২১১ কিলোমিটার নালার দেখভাল করে দুই সিটি করপোরেশন। রাজউকের নিয়ন্ত্রণে ৩০০ একরের হাতিরঝিল ও প্রায় ২৫ কিলোমিটার লেক। আর ডিএনডি এলাকা ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের আছে ৫২টি স্লুইসগেট ও একটি পাম্পস্টেশন। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত এই সংস্থাগুলো কোনো বছরই বর্ষার আগে নালা বা খাল পুরোপুরি পরিষ্কার করে না। ফলে ময়লা জমে কমে যায় পানি প্রবাহের সক্ষমতা। প্রকট হয় জলাবদ্ধতার সমস্যা। সংস্থাগুলোর মধ্যে সবার আগে কাঠগড়ায় তোলা হয় ঢাকা ওয়াসাকেই। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট আর বর্ষায় হাবুডুবু, নালা-খালে ভেসে বেড়ায় পয়োবর্জ্য। 

নানা ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে টানা ১১ বছর ধরে বহাল তবিয়তে থাকা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান নিজের কাজ সম্পর্কে বলেন, ‘ঢাকা হচ্ছে একটি বালতির মতো। বৃষ্টি যখন হয় তখন আশপাশের নদীগুলোতে পানি বেড়ে যায়। তখন পাম্প আউট করেই তা অপসারণ করতে হয়। আর ভূ-গর্ভে পানি যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আর্টিফিশিয়ালি ড্রেন নির্মাণ করেই পানি অপসারণ করতে হচ্ছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের যেসব খাল রয়েছে সেগুলো প্রতি বছর পরিষ্কার করি; কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার সলিড বর্জ্যে ভরে যায়। ফলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।’

ঢাকার ইঞ্জিন উল্টোপথে

রাজধানীতে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। এটিকেই সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা। কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই তারা জলাশয়, বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করছেন। অনেকে আবার বিভিন্ন খাল ও পানি নির্গমন পথ ভরাট করে বানাচ্ছেন বাড়িঘর। 

বর্তমানে শহরের বেশিরভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথই প্রায় বন্ধ। এ কারণে রাজধানীসহ আশপাশের শহরগুলোয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে জলাবদ্ধতা। পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও নগরের তাপমাত্রাতেও প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, নগরের তাপমাত্রা রক্ষা ও বৃষ্টির পানি সুষ্ঠুভাবে নির্গমনের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে দরকার জলাশয়গুলোকে রক্ষা। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আবাসন কোম্পানিগুলো জলাশয় ভরাট করে যে প্লট তৈরি করছে, সেগুলো হাউজিংয়ের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়। আমাদের যে পরিমাণ উন্নয়নকৃত জমি আছে, সেখানে পরিকল্পনা করে ভবন নির্মাণ হলে জলাশয় ভরাটের প্রয়োজনই পড়ত না।’

প্রকৃতি ঢেকে বাড়ছে কংক্রিট

ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাব) এলাকায় জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গত বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিআইপি। এতে তুলে ধরা হয় ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকা, মোহাম্মদপুরের বসিলা, সাভারের আমিনবাজার, রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুরের বেরাইদ, নারায়ণগঞ্জের বক্তার এলাকার জলাশয় ভরাটের আগের ও পরের চিত্র। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ, বৃষ্টির পানি সুষ্ঠুভাবে নির্গমনের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নগরের তাপমাত্রা রক্ষায় জলাধারের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, মহানগর এলাকায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয় থাকা দরকার; কিন্তু রাজধানীসহ সারাদেশের চিত্র তার ঠিক উল্টো, চারদিকেই চলছে ভরাটের প্রতিযোগিতা। এতে প্রতি বছরই হারিয়ে যাচ্ছে দেশের ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয়। 

ড্যাপের ২০১০ সালের ভূমি ব্যবহার ম্যাপ ও ২০১৯ সালের স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় মোট জলাভূমি ছিল ১ লাখ ৩৩৭ একর। সেখানে এরই মধ্যে ২২ শতাংশ অর্থাৎ ২২ হাজার ৫১৬ একরই ভরাটের মাধ্যমে দখল করে নেয়া হয়েছে। তাই নদী ও খালসহ যে কোনো জলাশয় সামনে রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এমন কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া ভূমি ব্যবসায়ীদের অবৈধ কার্যকলাপ রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও শাস্তির সুপারিশ করা হয়। 

এ বিষয়ে ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘প্রতি বছর গড়ে ডিএমডিপি এলাকার প্রায় দুই হাজার ৫০০ একর জলাশয় হারাচ্ছি আমরা। উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয় কমে যাওয়ায় আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে গরমের সময় অত্যধিক গরম পড়ে। খাল ও জলাশয়গুলো দখল হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি নামার জায়গা থাকে না। তাই অল্প বৃষ্টিতেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘শুধু নালা বা খাল দিয়েই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। প্রয়োজন পরিকল্পিত নগরায়ণ; সেখানে থাকবে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশই উন্মুক্ত স্থান, সবুজ এলাকা ও জলাধার; কিন্তু ঢাকা শহর সেভাবে গড়ে উঠেনি। ১৯৯৯ সালে মূল ঢাকা শহরের মোট ভূমির প্রায় ১৪ শতাংশ ছিল জলাভূমি। ওই সময় কংক্রিটে আচ্ছাদিত এলাকা ছিল ৬৫ শতাংশের মতো। ২০ বছর পর ২০১৯ সালে জলাভূমি কমে হয়েছে ৪.৩৮ শতাংশ, আর কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১.৮২ শতাংশে।’ 

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে ওয়াসা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডও ব্যর্থ। তাই সমাধান চাইলে এর দায়িত্ব দিতে হবে সিটি করপোরেশনকেই। আর সে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলে কার্যকর পরিকল্পনা করে আমাদের যে মহাপরিকল্পনার কাজ চলছে তার অংশ হিসেবে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করতে পারব।’ 

একই সুরে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের ভোগান্তি আমরা দেখছি; কিন্তু কিছু করতে তো পারছি না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //