দারিদ্র্যসীমায় দাঁড়িয়ে মধ্যবিত্ত

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে গেছে। বর্তমানের জীবন ও স্বপ্নের ভবিষ্যৎ হঠাৎ করেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে! 

অর্থনীতির আয় কাঠামোতে যারা মধ্যবিত্ত ছিলেন, সেই কাঠামোর বিচারে এখন তারা দরিদ্র অথবা নিম্নবিত্ত। সংক্রমণ ঠেকাতে অঘোষিত লকডাউন আরো মাসখানেক দীর্ঘায়িত হলে আরো তীব্র হোঁচট খাবে মধ্যবিত্তরা। এক ধাক্কায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হবে। 

জাতিগত ও আন্তর্জাতিক রূপরেখা অনুসারে, দারিদ্র্য দূরীকরণের অভিমুখে যাত্রা মোড় নেবে উল্টো পথে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের আঘাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তাৎক্ষণিক কর্মের নিশ্চয়তা। 

লায়লা খাতুন। রাজধানীর রামপুরার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। দারিদ্র্য ঘোচাতে মাত্র ১২ বছর বয়সে ঢাকায় আসেন। মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। এক যুগের সংগ্রামে তার বেতন এখন মাসে ১২ হাজার টাকা। তার স্বামী ঢাকায় সিএনজি চালক। দু’জনের আয়ে পরিবারের ব্যয় ও সন্তানদের লেখাপড়া ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অঘোষিত লকডাউন ঘোষণা করলে কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি হারান লায়লা। সিএনজি রাস্তায় নামাতে পারছেন না স্বামী। যে দারিদ্র্যের ভয়ে তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন, সেই দারিদ্র্যের অন্ধকারেই মহামারি তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে। আগের মতোই আবার ক্ষুধার যন্ত্রণা। লায়লা খাতুন বলেন, ‘পোশাক কারখানা আমাকে ও আমার পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে তুলে এনেছিল; কিন্তু করোনাভাইরাস আমাকে আবার সেখানেই ফেলে দিয়েছে।’

জুয়েলারি দোকানের কর্মচারী আনিসুর রহমান। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে স্বচ্ছল পরিবার তার। দোকানে কাজ করে যে বেতন ও নিজের উদ্যোগে গহনা বিক্রি করে যে কমিশন পান তাতে ঘরভাড়া, খাওয়া খরচ ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছিলেন ভালোভাবেই। লাখ খানেক টাকা ব্যাংকে সঞ্চয়ও আছে; কিন্তু লকডাউনের পর থেকে তার কাজ বন্ধ। এখন সংসার চালাচ্ছেন সঞ্চয় ভেঙে। আর দু’মাস গেলে সেই টাকাও শেষ হয়ে যাবে। এক মাস আগের মধ্যআয়ের আনিসুর রহমান এখন আয়হীন। কীভাবে সংসার চালাবেন, সেটি নিয়েই এখন দুশ্চিন্তা।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে অনেক পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থায় স্বচ্ছলতা আসে। বিদেশে পাড়ি জমিয়ে একজন মানুষ প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্তত এক কোটি বাংলাদেশি কাজ করছেন। তাদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে তাদের কাজ বন্ধ। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। 

সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন অবৈধ প্রবাসীরা। করোনাভাইরাসের কারণে মাত্র তিন মাসে ৬ লাখ ৬৬ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এখনো ৩০ থেকে ৪০ লাখ অবৈধভাবে রয়েছেন। শুধু সৌদি আরবে আছেন ১০ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি। 

তেলের দাম কমায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইতোমধ্যে মন্দা শুরু হয়েছে। মন্দায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বাংলাদেশিরা। তাদের আয় কমে যাবে, এমনকি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন অনেকেই। স্বচ্ছল পরিবার আবার দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হবে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স কমবে ২২ শতাংশ হারে। সর্বশেষ এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমেছে সাড়ে ২৪ শতাংশের মতো। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ২০.৫ শতাংশ। এই হিসাবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৪০ লাখের মতো। জাতিসংঘের হিসাবে, ২০০০ সালের পর বাংলাদেশ ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশকে দরিদ্র থেকে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। প্রতি বছর দারিদ্র্য কমছে; কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আর মাত্র এক মাস স্থায়ী হলে মানুষের আয় কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমে যাবে। এতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা একলাফে দ্বিগুণ হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার দাঁড়াবে ৪০.৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে যা ছিল ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫ বছর পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। 

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘এক মাস পেরিয়ে আসা এই লকডাউন তিন মাস স্থায়ী হলে দেশের মানুষের আয় ২৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। নতুন করে আরো ২০.৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস কারণে দরিদ্র ও অসহায়ে পরিণত হওয়াদের চিহ্নিত করতে হবে। যেসব খাতে সহায়তা প্রয়োজন ও দরিদ্র দূর করা যায়, সেখানে সঠিকভাবে সহায়তা পৌঁছাতে হবে।’

সানেমের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে নতুন যেসব মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে পারে তাদের মধ্যে ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু লালন-পালন ও মাছ উৎপাদন খাত থেকে ৪৩ শতাংশ, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প খাতের ১৬ শতাংশ, খুচরা ব্যবসা ১১ শতাংশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার ১০ শতাংশ ও নির্মাণ খাতের ৭ শতাংশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘লকডাউনের কারণে অনেকে কাজ হারাবেন। যারা আগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিলেন, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবেন। মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্তের সংকট বেশি হবে। সরকার যে সহায়তা কর্মসূচি হাতে নেবে, তাতে অবশ্যই নিম্ন মধ্যবিত্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’ 

জীবন বাঁচানোর জন্য আরোপ করা লকডাউন কর্মজীবী মানুষের আর্থিক শক্তি একেবারে ভেঙে দেবে- এমন ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক, আইএলওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বে দারিদ্র্যের হার বাড়বে। আয় বন্ধ হয়ে বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন। আর এই সংকট সবচেয়ে ভয়াবহ হবে বাংলাদেশের মতো নিম্ন পর্যায় থেকে উন্নয়নের ধারায় থাকা দেশগুলোর জন্য। 

অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ভারতীয় অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জি বলেন, ‘নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে টেনে তোলার লড়াই সহজেই ধ্বংসের মুখে পড়বে। অনেক মানুষ, যারা মই বেয়ে চূড়ায় উঠেছিল, তারা আবার নিচে পড়ে যাবে। শুধু টিকে থাকার জন্য লড়তে থাকা নাজুক অস্তিত্বের এত মানুষ এখন আবার এমন দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে, যা থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় তাদের নেই।’

বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পপতি ছাড়া সরকারি চাকরি ও বেসরকারি চাকরি এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ওপর জীবিকা নির্বাহ করে অধিকাংশ মানুষ। এর বাইরে অনানুষ্ঠানিকতাতেও কিছু মধ্য আয়ের মানুষ আছেন। এর বাইরে রয়েছে নিম্নআয় বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী। 

বিভিন্ন দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বিবেচনা করে বিশ্বের দেশগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করে বিশ্ব ব্যাংক। নিম্নআয়, দুই রকম মধ্যম আয় (নিম্ন-মধ্যম আয় ও উচ্চ-মধ্যম আয়) ও উচ্চ আয়ের দেশ। বাংলাদেশ ২০১৫ সাল থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ।

বিভিন্ন পেশাজীবীর পাশাপাশি ব্যবসা করে দেশের একটি বড় জনশক্তি। রাজধানীতে বিভিন্ন শপিংমলসহ সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের দোকান রয়েছে। এমন দোকান মালিকদের সংখ্যা ৫৬ লাখের মতো। আয়ের দিক থেকে তারা মধ্যবিত্ত কাতারের। লকডাউনের কারণে দোকান বন্ধ। এখন দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, ব্যাংকের ঋণের কিস্তি ও নিজেদের পারিবারিক খরচ মেটানোর মতো অর্থ আয় করতে পারছে না তারা। পহেলা বৈশাখের বেচাকেনা হয়নি। ঈদের বেচাকেনা হবে কিনা তাতেও সন্দেহ। 

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘দোকানিদের ৭৫ শতাংশ বেচাকেনা হয় রমজানের ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে; কিন্তু এবার কিছুই হলো না। আয়-উপার্জন একেবারে বন্ধ। পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তার কোনো ঠিক নেই। স্বাভাবিক হলেও লোকসান গুনতে হবে। কেননা মানুষের আয় কমে গেলে বেচা-বিক্রি অনেক কমে যাবে। এতে আমাদের টিকে থাকাই কষ্ট হবে।’ 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি তছনছ হয়ে যাচ্ছে। উৎসবকেন্দ্রিক সব মানুষের আয় বাড়ে; কিন্তু এবারের চিত্র ব্যতিক্রম। ধীরে ধীরে আয়হীন হয়ে পড়ছে মানুষ।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //