ভর্তুকির তেল ভারতে পাচার

বাংলাদেশের চেয়ে প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেশি। প্রায় প্রতিদিনই পুরনো রেকর্ড ভেঙে তা পৌঁছাচ্ছে নতুন উচ্চতায়।

বর্তমানে দেশটির আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ডিজেল কিনতে হচ্ছে ৭২ রুপি লিটারে, যা ৮৭ টাকার সমান। আর বাংলাদেশে সেই জ্বালানি বিক্রি হয় ৬৫ টাকায়। 

দু’দেশের মধ্যে ২২ টাকা দামের ব্যবধান হওয়ায় সীমান্ত এলাকায় হঠাৎ করে বেড়ে গেছে চোরাকারবার। এর নেপথ্যে রফতানি পণ্যবাহী ট্রাকের চালকরা। পণ্যের সঙ্গে কৌশলে তারা গাড়ির ট্যাংকিতে ডিজেল ভরে ওপারে গিয়েই বিক্রি করে দেয় চড়া দামে। 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ট্রাকচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ, সিলেটের তামাবিলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৩টির মতো স্থলবন্দর চালু রয়েছে। আর এসব বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে এক হাজারেরও বেশি ট্রাক রফতানি পণ্য নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। যেখানে প্রায় ৯০ ভাগ চালকই জ্বালানি তেল বিক্রি করে আসে। 

এতে করে প্রতিদিন পাচার হয়ে যাচ্ছে দেড় লাখ লিটার ভর্তুকির তেল। মাসে প্রায় ৪৫ লাখ লিটার। 

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এক কর্মকর্তা জানান, সবার ক্রয় ক্ষমতার কথা চিন্তা করে সরকার তেলে ভর্তুকি দিচ্ছে। দেশের সব পর্যায়ের লোকজনই এ সুবিধা ভোগ করেন। তাই বেশি দামে আমদানি করলেও বর্তমানে বিপিসি প্রতি লিটার ডিজেল ৬৫ টাকা, জেট ফুয়েল ৭১ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও ফার্নেস অয়েল ৪২ টাকায় কোম্পানিগুলোর (পদ্ম, মেঘনা, যমুনা) কাছে বিক্রি করছে। অথচ সেই তেল পাচার করে নিজেদের লাভের আশায় একটি চক্র দেশের বিশাল ক্ষতি করছে। তাদের কারণে প্রতি বছরই লোকসান গুণতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

স্থলবন্দর দিয়ে প্রায়ই ভারতে পণ্য নিয়ে যান ট্রাকচালক সেলিম মিয়া। কয়েক দিন আগে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে তার সঙ্গে কথা হলে জানান, ট্রাকে কয়েক ধরনের তেলের ট্যাংকি রয়েছে। যেসব গাড়ি সীমান্তে মালামাল আনা-নেয়া করে সেগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি ধারণ করতে পারে। কোনো কোনো ট্রাকে আবার ৪০০ থেকে ৫০০ লিটার তেল নেয়ার মতো ট্যাংকিও রয়েছে। আর যেসব চালক তেল পাচারের ধান্ধায় থাকে তারা সীমান্তে যাওয়ার আগে পুরো ট্যাংকি ভরে নেয়। ফিরে আসার জন্য ৫০ লিটারের মতো রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দেয়। 

অন্যদিকে আগে থেকেই ভারতীয় দালালরা কনটেইনার নিয়ে সীমান্ত এলাকায় বসে থাকে। বাংলাদেশ থেকে ট্রাক পৌঁছার পর ট্যাংকিতে পাইপ ঢুকিয়ে সেই তেল বের করে নেয় তারা। দেশে যে টাকায় এক লিটার ডিজেল কেনা হয়, তার থেকে ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি পাওয়া যায় তাদের কাছে। ফলে ২০০ লিটার তেল বিক্রি করলে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা লাভ পাওয়া যায়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি ট্রাক কতটুকু তেল নিয়ে ভারতে যাচ্ছে আর বেরিয়ে আসার সময় কতটুকু নিয়ে আসছে, তা কাস্টমসের দেখার দায়িত্ব। 

যদিও কাস্টমসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তা অস্বীকার করে বলেন, ‘সীমান্তে চোরাচালান রোধে আঞ্চলিক চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স রয়েছে। সেখানে বিজিবি, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা সদস্য; তাদেরই এটি দেখার দায়িত্ব। কাস্টমসের মূল কাজ হলো আমদানি-রফতানি পণ্য বৈধ না অবৈধ, তা দেখা।’ 

একাধিক ট্রাকচালক অবশ্য বলছেন, বিষয়টি কেউই পরীক্ষা করে না।

দেশি-বিদেশি শক্তিশালী সিন্ডিকেট

বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল প্রথমে রাখা হয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা গুপ্তখালের ট্যাংকারে। সেখান থেকে সরবরাহ হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা ডিপোগুলোতে। এর মধ্যে গোদনাইল ফতুল্লা ডিপো থেকে ঢাকার আশপাশের জেলায়; খুলনার দৌলতপুর থেকে খুলনা-যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়; বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও পাবনার আশপাশে; রংপুর রেলহেড ডিপো থেকে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম অঞ্চলে তেল সরবারহ করা হয়। 

এছাড়া হরিয়ান রেলহেড ডিপো থেকে তেল সরবরাহ করা হয় রাজশাহী অঞ্চলে; পার্বতীপুর ডিপো থেকে দিনাজপুরের আশপাশের বিভিন্ন জেলায় ও শ্রীমঙ্গল, ভৈরব, বরিশাল, ঝালকাঠি এলাকায়। 

তবে এসব ডিপো ঘিরে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বিমানের জ্বালানি জেট-ওয়ান থেকে শুরু করে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস ও জিওবি তেল প্রকাশ্যেই চুরি করে তারা। বেশি লাভের আশায় সেই তেল সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচার করে দেয়া হয় ভারতে। আর এ কাজের জন্য দুই দেশে রয়েছে অন্য আরেকটি চক্র। 

সেচ মৌসুমে শঙ্কা বেশি

ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে সেচ মৌসুম। এ সময়টায় প্রায় প্রতি বছরই কৃষকদের দোরগোড়ায় জ্বালানি তেল পৌঁছাতে কোথাও না কোথাও তৈরি হয় সংকট। এর অন্যতম কারণ পাশের দেশে তেল পাচার। বিষয়টিকে মাথায় রেখে ও অতীতের বিভিন্ন সময়ের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে এবার ধারণা করা হচ্ছে, চলতি সেচ মৌসুমে ১৮ লাখ টনের মতো ডিজেল প্রয়োজন। সরবরাহ নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে বিপিসি। 

পাশপাশি পাচার রোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। 

এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সামছুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করছি, এ বছর কৃষকদের কাছে খুব সহজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে পারবো।’ 

তবে বৈঠকে উপস্থিত অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভারতে তেল পাচারের শঙ্কার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচনা হয়েছে। কেননা প্রতিবেশী দেশটির কোথাও কোথাও আমাদের দেশের তুলনায় ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১৫ থেকে ২২ টাকা পর্যন্ত বেশি। তাই স্থানীয় পাচারকারী ছাড়াও স্থলবন্দর দিয়ে যে ট্রাকগুলো দুদেশে পণ্য আনা-নেয়া করে সেগুলোর মাধ্যমে তেল পাচারের সুযোগ থাকে। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিজিবিকে সতর্ক করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সীমান্তবর্তী পেট্রোলপাম্পগুলোকেও দেয়া হচ্ছে বিশেষ নির্দেশনা।’

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েলও পাচার হচ্ছে

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিশাল ভর্তুকি দিয়ে আমদানি করা ফার্নেস অয়েলও পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারত ও মিয়ানমারে। অভিযোগ আছে বিপিসি আওতাধীন তিন কোম্পানি থেকে ভুয়া ডিও লেটার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার জ্বালানি তেল চুরি হয়ে যাওয়ারও। এর পেছনের কারিগর খোদ বিপিসি ও অধীনস্থ কোম্পানির কর্মকর্তারাই। 

গত আগস্টে রাষ্ট্রীয় তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েলের পতেঙ্গা গুপ্তখাল প্রধান ডিপো থেকেই প্রায় ৭৮ হাজার লিটার তেল চুরি হয়। ওই ঘটনায় গঠিত কমিটি প্রাথমিক তদন্ত করে দুজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়। একইভাবে গত ১০ আগস্ট যমুনা ডিপোর ডলফিন জেটিতে আসা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমটি পামির থেকে গুপ্তখাল ডিপোতে খালাসের পর প্রায় ৭৮ হাজার লিটার তেল বেড়ে গেলে শুরু হয় তোলপাড়। ধারণা করা হয়, বিপুল এই ফার্নেস অয়েল অন্যত্র সরিয়ে বিক্রির চেষ্টা চালিয়েছিল কয়েকটি চক্র। 

তারও আগে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর এমটি রাইদা ও এমটি মনোয়ারা নামে দুটি জাহাজে ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৮২ লিটার ডিজেল ভরে পাচার করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় জড়িত যমুনার পাঁচ কর্মকর্তাকে দেয়া হয় সব ডিজেলের মূল্য পরিশোধের শাস্তি। 

এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার নৌপথে ড্রামে ও অবৈধভাবে ফিশিং ট্রলারে করে তেল পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়তই। এমনকি একটি শক্তিশালী চক্র দেশের খোলাবাজার থেকে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা লিটারে ফার্নেস অয়েল কিনে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে বিদেশি জাহাজে অবৈধভাবে সরবরাহ করছে।

তেল যায় মোটরসাইকেলে

কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্ত দিয়ে মোটরসাইকেলে করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে জ্বালানি তেল পাচারের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, সীমান্ত এলাকায় প্রচুর মোটরসাইকেল চলে। বেশিরভাগেরই রেজিস্ট্রেশন নম্বর নেই। এসব মোটরসাইকেলের একটা বড় অংশই ভারত থেকে চোরাই পথে আনা। কাগজপত্র ঠিকমতো যাচাই করা হয় না বলে দাপিয়ে বেড়ায় পুরো জেলায়। 

আর চালকরা যাত্রী টানার আড়ালে জ্বালানি তেলসহ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। তাদের মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই কয়েক হাজার পেট্রোল ও ডিজেল চলে যাচ্ছে ভারতে। আর এসব কাজের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খাল বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যও জড়িত বলে জানা গেছে। 

পেট্রোল পাম্পের মালিকরা অবশ্য বলছেন, বিজিবি সদস্যদের তদারকিতে সেটা আগের চেয়ে অনেক কমেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //