বড় সংকটেও এগোচ্ছে অর্থনীতি!

দেশের ব্যাংকিং খাত চরম দুর্দশায়। শেয়াবাজারে চলছে চরম সংকট। প্রতিনিয়ত কমছে রাজস্ব আদায়। বৈদেশিক বাণিজ্যেও কালো মেঘ। প্রকল্পের নামে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে ব্যাপকহারে। ব্যাংকের টাকা ঋণখেলাপিদের পকেটে। শেয়ারবাজারে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে দুষ্টচক্র। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় পাঁচ চালকের এই সংকটের মধ্যেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে চলেছে? প্রবৃদ্ধিনির্ভর এই উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশে রয়েছে। অথচ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই বাড়তি ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির উৎস কী- এতে আমরা চিন্তিত। বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বকালের মধ্যে কম, ব্যাংকের তারল্যের সংকট, ব্যাংক টাকা ফেরত পাচ্ছে না, শেয়ারবাজারে সংকট- অথচ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। যারা যে তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে প্রবৃদ্ধি নিরূপণ করেছেন তারা প্রকাশ্যে এসে এর ব্যাখা দেন। প্রবৃদ্ধির তথ্যভিত্তিক প্রমাণ সামনে এলে তখন আলোচনা করা যাবে- দেশের উন্নতি কতটুকু হয়েছে। প্রবৃদ্ধির উন্নয়নমূলক উপাখ্যান দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এতে করে পরাবাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।’

ব্যাংক খাত
আমাদের মতো ছোট একটি দেশে ৫৯টি ব্যাংক কার্যরত রয়েছে। নতুন করে আরও ৩টি ব্যাংক অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এরপরও ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ ক্রমেই কমছে। সুশাসনের অভাব, খেলাপিঋণসহ নানা সংকটে জর্জরিত দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংকগুলোতে মোটাদাগে ৭টি প্রধান সমস্যা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সর্বকালের সবচেয়ে কম ঋণ বৃদ্ধি, তারল্য সংকট, নয়-ছয় সুদহার কার্যকর, খেলাপি ঋণ, গণহারে পুনঃতফসিল ও অবলোপন, মূলধন ঘাটতি ও মূলধন জোগান। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১০.৬৬ শতাংশ। এই বৃদ্ধির হার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ার কারণ তারল্য সংকট। অনেক ব্যাংকের কাছে ঋণ দেওয়ার মতো অর্থও নেই। আর তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে আমানত সংগ্রহ না বাড়ার কারণে। গত দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির গড় হার ১.১২ শতাংশ, যেখানে আমানত বেড়েছে ০.৮৪ শতাংশ হারে। আমানতের তুলনায় ঋণ বৃদ্ধি বেশি হওয়ায় তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

অন্যদিকে আমানত না বাড়ার অন্যতম কারণ সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশে বেঁধে দেওয়া এবং জাল-জালিয়াতির কারণে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া। আগস্টের হিসাবে, ব্যাংকগুলোতে আমানতের বিপরীতে প্রকৃত সুদ (প্রদত্ত সুদের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে) পাওয়া যাচ্ছে ০.১১ শতাংশ। আর সঞ্চয়পত্রে প্রকৃত সুদহার ৫.৯১ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেশি হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এজন্য বিকল্প ক্ষেত্রে টাকা রাখছে মানুষ। 

ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। এটি মোট জিপিডির ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা শিক্ষা বাজেটের দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেটের চারগুণ। তবে খেলাপি ঋণ প্রকৃত পক্ষে আরও বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, অবলোপন ও মামলাসহ খেলাপি ঋণ প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদ খাতুন বলেন, ‘ব্যাংক খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত। এসব সংকট সরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে ব্যাংকের মালিকানা ও ঋণ আটকে আছে। ব্যাংকের টাকা ফেরত আসছে না। বেসরকারি ঋণ বাড়ছে না। অথচ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এটি প্রশ্নবিদ্ধ।’

পুঁজিবাজার 
বিনিয়োগকারীদের অর্থের জোগান দিতে বিকল্প উৎস হিসেবে গড়ে তোলা হয় পুঁজিবাজার; কিন্তু সেটি হতে পারেনি দেশের দুই মার্কেট। উল্টো এখানে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে অসাধু বিনিয়োগকারীরা কারসাজির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। গণপ্রস্তাব (আইপিও) ইস্যু করা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে কারসাজি রয়েছে। বিও অ্যাকাউন্ট নিয়ে রয়েছে অস্বচ্ছতা। খাতে-কলমে দেখানো হচ্ছে ২৭ লাখ বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে। অথচ আরেকটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে মোট বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে প্রায় ৬৭ লাখ। জেড ক্যাটাগরির কোম্পানি যারা ৩ বছর ধরে ডিভিডেন্ট দেয় না, এজিএম করতে পারে না- তারা থাকে শীর্ষ গেইনারের তালিকায়। এক সময় পুঁজিবাজারের লেনদেন হতো ৩ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটি ৩০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। 

শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে সিপিডির গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘পুঁজিবাজারে দুষ্টচক্রের আনাগোনা বেড়েছে। এর ফলেই ক্রমাগতভাবে পতন হচ্ছে সূচকের। দুর্বল আইপিও, অস্বচ্ছ বার্ষিক প্রতিবেদন, বিও অ্যাকাউন্টের অপর্যাপ্ত স্বচ্ছতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম অস্থিতিশীল করে তুলেছে পুঁজিবাজারকে। বাজারে কোনো আর্থিক সংকট নেই। মূল সমস্যা সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব।’

রাজস্ব আদায় 
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে ৭২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের প্রকৃত আয়ের তুলনায় লক্ষ্যমাত্রার বাড়ানো হয়েছে ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের দুই মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে (জুলাই-আগস্ট) ২৯ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আদায় বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় অনেক কম। রাজস্ব আদায় কম হওয়ার কারণে সরকার ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।  

সিপিডির সিনিয়র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেশে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেই হারে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। আয় না বাড়লে প্রবৃদ্ধি কিভাবে বাড়ে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হলে সরকারকে টাকার জন্য ব্যাংক ঋণ নিতে হবে। ব্যাংক ঋণ বেশি নিলে ব্যক্তিখাতের চাপ বাড়বে। এতে বিনিয়োগের প্রভাব ফেলে প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াতে পারে।’ 

বৈদেশিক বাণিজ্য
বাংলাদেশের রফতানি আয় ৪ হাজার কোটি ডলার, আমদানি ব্যয় ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার, রেমিট্যান্স আয় দেড় হাজার কোটি ডলারের বেশি, বিদেশি বিনিয়োগ ৪০০ কোটি ডলার- সবমিলিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি ডলারের মতো। নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রফতানি আয় প্রায় ৩ শতাংশ কমেছে। এর আগে গত দশ বছরের মধ্যে কখনো প্রথম প্রান্তিকে রফতানি আয় কমেনি বরং বেড়েছে। এই সময়ে পোশাক খাতে আয় ১.৬০ শতাংশ এবং অন্য খাতে ৯.১০ শতাংশ কমেছে। প্রতিযোগী অন্যদেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের রফতানি আয় কম। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি আয় হয়েছে ৩.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যেখানে চীনের ৪ শতাংশ, তুরস্কের ১০ শতাংশ, ভিয়েতনামের ১২ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ শতাংশ। রফতানি আয় বাড়াতে প্রতিযোগী দেশগুলো ডলারের বিপরীতের তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে ব্যাপকহারে। বাংলাদেশ কমালেও তা অনেক কম। জানুয়ারির তুলনায় সেপ্টেম্বরে টাকার মান বাংলাদেশ কমিয়েছে ০.৭০ শতাংশ। অন্যদিকে কম্বোডিয়া ২ দশমিক ১০ শতাংশ, চীন ৪.৮০ শতাংশ, পাকিস্তান ১২.৬০ শতাংশ ও ভিয়েতনাম ১.৩০ শতাংশ মুদ্রার মান কমিয়েছে। অর্থাৎ তাদের মুদ্রার দাম কমেছে, এর বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে। তবে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনায় রেমিট্যান্স আয় বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চারমাসে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ৬১৫ কোটি ডলার- আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫১০ কোটি ডলার। দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যালান্স থাকার হওয়ার কথা ৫৪৬ কোটি ডলার-অথচ রয়েছে মাত্র ১২ লাখ ডলার। অর্থাৎ পরিকল্পনার তুলনায় প্রকৃত অর্জনের ফারাক অনেক বেশি। 

গত ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। ২০১৬-১৭ বছরের রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ডলার- যা দিয়ে দেশের ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু এরপরের বছরগুলোতে রিজার্ভ ৩ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ ডলারে ওঠানামা করছে। এই সময়ে আমদানির ব্যয়ের চাহিদা বেড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৮৯ কোটি ডলার। এটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কাছাকাছি। 

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত দশ বছরের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানি আয় কমেছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তিদায়ক অবস্থা থেকে সরে আসছে। জিডিপিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের বড় প্রভাব রয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি হলে প্রবৃদ্ধিও কমার আশঙ্কা রয়েছে।’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //