মতাদর্শ ও আন্দোলনের আর্কাইভ

নূহ-উল আলম লেনিন একসময় সিপিবির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুধু যুক্ততা নয়, ছাত্র রাজনীতি, কৃষক আন্দোলন থেকে মূল পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছিলেন। বিপ্লবী বাবা রহমান মাস্টারের সুযোগ্য সন্তান তিনি। সরদার ফজলুল করিম তার বাবাকে নিয়ে বই লিখেছেন। রহমান মাস্টার কৃষক আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা ছিলেন। বলা যায়, পারিবারিক উত্তরাধিকারে তার রাজনীতির হাতেখড়ি। 

মানুষের মুক্তির রাজনীতি থেকে একসময় ছিটকে পড়লেন তিনি। জীবনের প্রারম্ভে যে মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে রাজনীতি করেছিলেন, তার বিপরীতমুখী উঠানে গিয়ে দাঁড়ালেন জীবনের মধ্যাহ্ন পর্যায়ে। তারপরও আর দশজন ডিগবাজী দেওয়া নেতা তিনি নন এই কারণে যে, অনেক বামপন্থী নেতা রাজনীতির মতাদর্শ পরিবর্তন করেও, পরবর্তীতে নিজের চরিত্র ঠিক রাখতে পারেননি। লুটপাট আর বল্গাহীন বুর্জোয়া স্রোতধারায় মিশে গিয়ে অতীত রাজনীতিকে ভুলে গেছেন। কিন্তু নূহ-উল-আলম লেনিন এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি বুর্জোয়া রাজনীতির কাছে সমর্পণ করলেও তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। লেখালেখি, গবেষণা আর সৃজনধর্মী পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। 

২০১৫ সালে ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস প্রসঙ্গ ও দলিলপত্র’ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই বই দুটি যেন, ইতিহাসের আর্কাইভ। তিনি যে কাজটি করেছেন সেটি একার পক্ষে করা অনেকক্ষেত্রে জটিল এ কারণে যে, এ ধরনের দলিলপত্র সম্পাদনার কাজগুলো পার্টি বা কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানই করে থাকে এবং অবশ্যই সেটি একটি সম্পাদনা পরিষদের মাধ্যমে। 

যে মতাদর্শের রাজনীতি ছেড়ে এসেছেন আবার সেই মতাদর্শের দলিলপত্র যখন নিজ উদ্যোগে প্রকাশের আলোর মুখ দেখান, তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে- কেন তিনি এসব কাজ করছেন? উত্তর হতে পারে, তিনি পূর্বোক্ত রাজনীতিকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারেননি এবং তার হৃদয়ের মনি কোঠায় এখনও তা ক্রিয়াশীল। 

আমাদের এই ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু শাসকগোষ্ঠী নয় বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীও তাদের বিপরীত চিন্তার দলিলপত্র ধ্বংস করে ফেলেছে। কিন্তু তিনি এতো এতো বছরের সঞ্চিত সম্পদকে আমাদের কাছে উন্মোচিত করলেন। এ কাজটার মধ্য দিয়ে শুধু ক্রিয়াশীল বামপন্থী রাজনীতির চিন্তক, নেতা ও কর্মীদেরই উপকার হবে না; ভবিষ্যতে যে কোন গবেষকেরও কাজে লাগবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

বইটির প্রথম খণ্ডে বেশিরভাগই বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের লিফলেট বা প্রচারপত্র এবং পার্টির নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্দেশনামূলক সার্কুলার আছে। 

‘অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই)- বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির দলিলপত্র (১৯৪৪-১৯৪৭)’- শিরোনাম অধ্যায়ে প্রচারপত্র ও সার্কুলার বাদে ‘দিনাজপুরে কাপড়ের আন্দোলন’ নামে একটি প্রবন্ধ বিভূতি গুহ নামে আছে। এতে ওই সময়কার দিনাজপুরের কাপড়ের আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। 

পার্টি সংগঠক নামে একটি পুস্তিকা আছে। এটি পার্টির নামে প্রকাশিত হয়েছে। এই পুস্তিকাটি আজকের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নেতা-কর্মীদের গাইডলাইন হিসেবে। 

‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি: পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির দলিলপত্র (১৯৪৮-১৯৫১)’ শিরোনাম অধ্যায়ে অনেকগুলো লিফলেট ও সার্কুলারের সাথে ‘কাশ্মীর ও আমাদের নীতি’ নামে একটি দীর্ঘ বক্তব্য আছে। এই সময়েও কাশ্মীর সমস্যাকে পর্যালোচনা করতে লেখাটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। 

‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি: কেন্দ্রীয় কমিটির দলিলপত্র (১৯৪৯-১৯৫১)’ শিরোনামের অধ্যায়ের প্রথমেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনকারী কমিউনিস্ট বন্দীদের নামের তালিকা আছে। এর সঙ্গে হাজং আন্দোলনকারীদের প্রতি একাত্মতা করে পার্টির একটি প্রচারপত্র আছে। এ অধ্যায়ে ভাষা আন্দোলনের উপর বেশ কয়েকটি লিফলেট আছে, সেই সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের উপর নির্দেশনামূলক ও পর্যালোচনামূলক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টির সার্কুলার আছে। শ্রমিক আন্দোলন নিয়েও নির্দেশনামূলক সার্কুলার আছে। কয়েকটি ছদ্মনামে চিঠি আছে। শিরোনামহীন কয়েকটি পার্টির নির্দেশনামূলক সার্কুলার আছে। সম্ভবত পার্টি গোপন অবস্থায় থাকার কারণে এভাবে শিরোনামহীন সার্কুলার প্রকাশিত হয়েছে। 

বইটির ২য় খণ্ড ১ম খণ্ডের চেয়ে অনেকখানি সমৃদ্ধ। ২য় খণ্ডের প্রথম দলিলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা জানি সোভিয়েত পার্টি ও চীন পার্টির মতবাদিক বিতর্কের ফলশ্রুতিতেই পৃথিবীর কমিউনিস্ট পার্টিগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তখনকার অবিভক্ত পাকিস্তান ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এর বাইরে ছিল না। 

আমরা নতুন প্রজন্ম সঙ্গত কারণে প্রশ্ন তুলতে পারি যে, সেই মহাবিতর্কের ফলে পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলন সমৃদ্ধ-সফল না ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু এখানে ‘বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই নীতি, সেপ্টেম্বর ১৯৬৪’ নামে যে দলিলটি ছাপা হয়েছে তার তথ্যগত বিভ্রাট আছে। এই দলিলটি কি এক পার্টির সময়কার না, দ্বি-বিভক্ত হওয়ার পর কোন অংশের তা উল্লেখ  নেই। 

এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার চারটি সংখ্যা স্থান পেয়েছে। পার্টি বিভক্তির পর মস্কোপন্থী অংশের প্রথম কংগ্রেসের রিপোর্ট আছে। প্রথম গঠনতন্ত্রও আছে। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে সিপিবির ভূমিকা জানার জন্য ১৯৭১ সালের পার্টির কিছু ডকুমেন্টস আছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পার্টির মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ’- এর একটি সংখ্যা আছে। যেটি ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। 

২য় খণ্ডে পার্টি বিভক্তির পর মস্কোপন্থী অংশের দলিলপত্রাদি স্থান পেয়েছে। ১৯৭১ সালের পরের দলিলগুলো প্রকাশিত হলে নতুন প্রজন্ম আরও উপকৃত হতে পারতো। বিশেষ করে পার্টির সব কংগ্রেসের দলিলগুলো নতুন খণ্ডে একত্রিত করে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য জনাব নূহ-উল-আলম লেনিনকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। 

পাশাপাশি পিকিংপন্থী অংশের গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলো জনাব নূহ-উল-আলম লেনিনের কাজগুলোতে উৎসাহী হয়ে কোন ব্যক্তি যদি করেন, তাহলে সম্পূর্ণ একটা কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস। 

বই পরিচিতি
কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস প্রসঙ্গ ও দলিলপত্র 
রচনা, গ্রন্থনা ও সম্পাদনা: নূহ-উল-আলম লেনিন
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ 
কনকর্ড এম্পরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স (বেজমেন্ট) 
কাঁটাবন, ঢাকা
মূল্য: প্রথম খণ্ড- ৮০০ টাকা, দ্বিতীয় খন্ড- ১০০০ টাকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : মাসুদ রানা

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //