বিশৃঙ্খল স্বাস্থ্য খাতে উপেক্ষিত মতামত

দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলার অভিযোগ নতুন নয়। তবে তা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় প্রকট আকার ধারণ করেছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস আঘাত হানার পর। তবে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিও রশি টেনে ধরতে পারেনি স্বাস্থ্য খাতে অনিয়মের লাগামহীন ঘোড়ার। উল্টো বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দেয়া প্রায় সব প্রস্তাবই উপেক্ষিত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে, এমন ব্যক্তিরা পাচ্ছেন সম্মানজনক বিদায় ও পদোন্নতি। রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ প্রত্যাখ্যাত হলেও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা হওয়ার বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে বিপজ্জনক হিসেবে।

আছে কমিটি, নেই সমন্বয়

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি বড় কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে, গত ১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন করা হয়। ওই সময় জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও কমিটি করা হয়। পরে ২৮ মার্চ আট জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এরপর মহামারির প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে ১৯ এপ্রিল রোগটির কমিউনিটি সংক্রমণ ও বিস্তার রোধের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে ১৭ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ গঠন করা হয়।

এসব কমিটি গঠনের সময় বলা হয়, জাতীয় ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রয়োজনবোধে যে কোনো কমিটির এক বা একাধিক সদস্যের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারবে। আর টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সরকারকে কভিড-১৯ প্রতিরোধ, হাসপাতালে সেবার মান বৃদ্ধি, যেসব চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসকসহ অন্যদের উৎসাহ প্রদানে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় ও কভিড-১৯ ভ্যাকসিনসংক্রান্ত গবেষণার বিষয়ে পরামর্শ দেবেন; কিন্তু এই কমিটিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ নেই বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ফোনেও পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ তুলেছেন কমিটিগুলোর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সদস্য। অপরদিকে দেশে করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় রোগটি মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় ও বিশেষজ্ঞ কমিটিগুলোর পরামর্শ ঠিক কতটা মানা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনায় সাংবিধানিক কমিশনের দাবি

স্বাস্থ্য খাতের চলমান অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিষয়ে ‘জনস্বাস্থ্য কনভেনশন-২০২০’ আয়োজন করে গণসংহতি আন্দোলন। ২৫ জুলাই আয়োজিত ওই কনভেনশন থেকে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি রোধে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়। বক্তারা বলেছেন, পরিস্থিতির উত্তরণে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। ওষুধ কোম্পানি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মুনাফার লাগাম টেনে ধরার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

বক্তারা বলেন, করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপুল দুর্নীতি, সমন্বয়হীনতা, জনগণের স্বাস্থ্যের প্রতি চরম উদাসীনতা এবং জবাবদিহিহীন আমলাতান্ত্রিকতা দেখা যাচ্ছে। এই কনভেনশনের উদ্বোধন ঘোষণা করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘একটি ভ্যাকসিন রিসার্চ হবে, তাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এত মাথাব্যথা কেন? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ভূতের প্রবেশ ঘটেছে, চক্রান্তকারীদের প্রবেশ ঘটেছে। ঠিক যেভাবে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানিসহ পুঁজিবাদের ধারকরা তৃৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠস্বর বন্ধ করে রেখেছিল।’

টিআইবির গবেষণায় এসেছে সমন্বয়হীনতার চিত্র

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রাক-সংক্রমণ প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে ও সংক্রমণকালে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিতকরণে গবেষণা চালিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এই গবেষণায় দেখা য়ায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ‘জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল’ গঠিত হওয়ার বিধান থাকলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিজে এককভাবে নির্দেশনা প্রদান করছেন।

করোনাভাইরাস মোকাবেলার অন্যতম বিষয় হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। অথচ শীর্ষ নীতি-নির্ধারণী জায়গায় কোনো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নেই। এ ছাড়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক করোনাকালে বিভিন্ন বিষয়ে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে তা প্রত্যাহার, কভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক দুই ধরনের তথ্য প্রদান, বিভিন্ন হাসপাতালে কভিড-১৯ চিকিৎসা প্রদান বিষয়ে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে।

এছাড়া, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, যোগাযোগ, বাণিজ্য, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রত্যাশিত হলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রেখেই ছুটি ঘোষণার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢাকা ত্যাগ, জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানের (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) অগোচরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সারাদেশে কার্যত লকডাউনের মাঝে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঢাকায় ফেরা, গার্মেন্টস খোলা রাখা, মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ, ঈদের সময় রাস্তা খুলে দেয়া বা বন্ধ রাখা ইত্যাদি ঘটনা আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়হীনতার বিষয়টি উন্মোচন করে, যা কভিড-১৯ সংক্রমণের বিস্তারে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়া, মহামারি প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যেমন প্রথমে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পরবর্তীতে সমালোচনার কারণে কমিটি সংশোধন করে আইজিপিকে যুক্ত করা হয়।

ঈদের পরে সংস্কার!

রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জোর গুঞ্জন রয়েছে ঈদুল আজহার ছুটি শেষে ব্যাপক রদবদল আসতে পারে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকে গতিশীল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রদবদল করা হতে পারে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রদবদলের জন্য দলের ভেতরে ও বাইরে থেকে ব্যাপক চাপ রয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে ‘টেবিল ওয়ার্ক’ করছেন বলে জানা গেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //