রিজেন্টের সাহেদ অস্ত্রসহ গ্রেফতার

করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদানসহ বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

বুধবার (১৫ জুলাই) ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীর সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, সাহেদ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিল। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে হয়ত তাকে আর পাওয়া যেত না। হেলিকপ্টারে করে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

এর আগে সোমবার (৬ জুলাই) রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে।

এরপর মঙ্গলবার (৭ জুলাই) রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় দণ্ডবিধি ৪০৬/৪১৭/৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/২৬৯ ধারায় প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদকে এক নম্বর আসামি করে ১৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়।

ওইদিন রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক চুক্তি (এমওইউ) বাতিলসহ অবিলম্বে হাসপাতালটির সব কার্যক্রম বাতিল এবং সিলগালা করার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

রিজেন্ট হাসপাতালে র‍্যাবের অভিযান, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ- হাসপাতালটি করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করত। সরকারের সঙ্গে হাসপাতালটির চুক্তি ছিল ভর্তি রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবে। সরকার এই ব্যয় বহন করবে। কিন্তু তারা রোগীপ্রতি লাখ টাকার বেশি বিল আদায় করেছে। রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে এই মর্মে সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিল জমা দেয়। রিজেন্ট হাসপাতাল এ পর্যন্ত ২০০’র মতো কভিড রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে।

এদিকে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৯ জুলাই) পুলিশের পক্ষ থেকে ইমিগ্রেশন বিভাগকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, প্রতারণা মামলার আসামি সাহেদের বিরুদ্ধে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তিনি যেন দেশের বাইরে যেতে না পারেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে।


যেভাবে সাহেদের উত্থান

পড়াশুনার দৌড় মাত্র এসএসসি পর্যন্ত। গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার। সঙ্গে গানম্যান। নিজেকে কখনো অবসরপ্রাপ্ত মেজর, কখনো কর্নেল কখনোবা সচিব পরিচয় দিতেন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মহাপ্রতারক মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস ছিলেন বলেও নিজের পরিচয় দিতেন কখনো কখনো।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেই ছবি বিলবোর্ডে সাঁটিয়ে দিয়েছেন হাসপাতালের সামনে। ২০১৩ সালে হাসপাতালের লাইসেন্স নেয়ার পর আর নবায়ন করার গরজ অনুভব করেন নি। লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানকে করোনার মতো স্পর্শকাতর চিকিৎসাসেবা দেয়ার অনুমতি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শুরু থেকেই এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে করোনা চিকিৎসা নিয়ে নানা অভিযোগ ছিলো। এসব অভিযোগ আসায় সোমবার হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব।

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ হাওয়া ভবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েও ঢুকে পড়েন আওয়ামী লীগে। মন্ত্রীসহ প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে সাহেদের অন্তরঙ্গ ছবি ঘুরপাক খাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই ছবিতে অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করছেন। ছবিতে বিশিষ্ট ওই লোকদের সঙ্গে সাহেদের বেশ অন্তরঙ্গই দেখা গেছে। অথচ অনেক আগে থেকেই এ সাহেদের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতারণার অভিযোগ।

গত ৯ বছরেই রাজধানীর বিভিন্ন থানায় সাহেদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অন্তত ৩২টি মামলা হয়। এমন অভিযোগের পরও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো বাছবিচার ছাড়াই কীভাবে সাহেদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে ছবি তুললেন তা নিয়েই জনমনে নানা প্রশ্ন। এসএসসি পাস সাহেদ করিম রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক। শুধু হাসপাতালই নয়; এমএলএম কোম্পানি, পত্রিকাসহ আরো কত কিছুর মালিক এই সাহেদ! উপার্জন করেছেন কোটি কোটি টাকা। বিশিষ্ট অনেক ব্যক্তির সাথেই তার ছিলো দহরমমহরম। প্রতারণায় তিনি এ সম্পর্ককেই ব্যবহার করে আসছিলেন।

জানা গেছে, ২০১১ সালে ধানমন্ডিতে এমএলএম ব্যবসা করে গ্রাহকদের ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। তখন লোকে তাকে চিনতো মেজর ইফতেখার করিম নামে। কখনো মেজর, কখনো সচিব. ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর এপিএস হিসেবেও নিজের পরিচয় দিয়েছেন।

মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ থেকে ৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার নথিতে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হিসেবে জাহির করেন। এ বিষয়ে আদালতে দুটি মামলা চলছে এখনো। সাহেদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় দুটি, বরিশালে একটি, উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩২টি মামলা রয়েছে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে প্রতারণার মামলায় তাকে একবার গ্রেফতারও করা হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাহেদসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন।

প্রশাসন জানায়, অভিযোগের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছিল। বেরিয়ে এসেছে কী পরিমাণ অনিয়ম এখানে হয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান চলছে।

র‌্যাব সূত্র জানায়, করোনাকালে ১০ হাজার রোগীর করোনা টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করে রিজেন্ট হাসপাতাল। মাত্র চার হাজার ২৬৪টি নমুনা সরকারিভাবে টেস্ট করে রিপোর্ট দেয়। বাকি পাঁচ হাজার ৭৩৬টি পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেয়া হয়। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চুক্তি অনুযায়ী, বিনামূল্যে করোনা টেস্ট ও চিকিৎসা দেয়ার কথা ছিলো; কিন্তু ১০ হাজার টেস্টের বিপরীতে রিজেন্ট প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া ভর্তি রোগীপ্রতি এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা বাবদ বিল করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার শুধু জুন মাসেই সরকারের কাছে চিকিৎসা বিল বাবদ পাঠানো হয় এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার হিসাব। সেবার নামে এভাবেই অনৈতিকভাবে অর্থ আদায় করেছে রিজেন্ট। আর যখনই এসব নিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো তদন্ত শুরু করে, তখন নিজেকে বাঁচাতে সাহেদ রিজেন্ট হাসপাতালের তিন কর্মকর্তাকে বরখাস্তের একটি নাটক করেন।

সাহেদের এ প্রতারণার চিত্র জনসমক্ষে এলে বিব্রত অবস্থায় পড়েন প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-এক্টিভ করার আগেই সাহেদের ওয়াল থেকে অনেকেই ওই সব ছবি নিয়ে ভাইরাল করেন। অনেককেই দেখা গেছে, সাহেদের সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতারণার কাজে সাহেদ এ ছবিগুলো ব্যবহার করতেন। এমনকি অনেক মানুষকে নানা সময় অস্ত্র ঠেকিয়ে হুমকি দিয়েছেন-এমন অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, কয়েক বছর ধরে নানা পরিচয়ে অপকর্ম করে আসছিলেন সাহেদ করিম। সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় তার বিষয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে সতর্কতাও জারি করা হয়েছিল। বিভিন্ন ভিডিও এবং স্থির চিত্রে দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্ত সাহেদ করিম ঢাকার বাইরে গেলেই প্রভাব খাটিয়ে পুলিশ স্কট ব্যবহার করেছিলেন। তার অফিস কক্ষের টর্চার সেলে নির্যাতনের স্থির চিত্রও প্রকাশ হচ্ছে এখন।

আরিফুর রহমান সোহাগ নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, তার গাড়ি কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে মেয়ে কেলেঙ্কারি সবকিছুই আমি জানতাম। যার কারণে সে কখনোই আমাকে ছাড়তে চায় না। এছাড়াও আমাকে বলছে, আমি যদি কোথাও মুখ খুলি তাহলে আমাকে জানে মেরে ফেলবে।

প্রধানমন্ত্রীর এপিএস পরিচয়ে হুমকি দেয়ার পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণাসহ নানা ধরনের অপকর্ম করে গেছেন আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম। ঢাকা শহরের বাইরে চলাচলের সময় পেয়েছেন পুলিশি নিরাপত্তা। এমনকি অপকর্ম ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে এক কর্মচারীর পুরো পরিবারকে মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। সাহেদ করিমের প্রতারণা বিষয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে আগেই সতর্কতা জারি করা হয়েছিল।

জানা গেছে, হাসপাতালটির মালিক মোহাম্মদ সাহেদ বিএনপির সময় বিএনপি, আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগ হয়ে যান। হাওয়া ভবনে তার যাতায়াত ছিলো। বিএনপি সরকারের আমলে মীর কাসেম আলী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। খাম্বা মামুনের সঙ্গে সে ২ বছর জেলও খেটেছে। ২০১১ সালে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোডে এমএলএম কো. বিডিএস ক্লিক ওয়ানের ব্যবসা করে সাধারণ মানুষের ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৩২টি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে নিজেকে কর্নেল (অব.) পরিচয় দিয়ে মার্কেন্টাইল কোঅপারেটিভ ব্যাংক বিমানবন্দর শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা লোন নেয়া নিয়েও তার বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা চলছে। বিভিন্ন টিভির টকশোতে মোহাম্মদ সাহেদকে দেখা যেত। তার প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট কে সি এস লি. এর নামে ইউসিবি ব্যাংক উত্তরা শাখাসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শত শত কোটি টাকা রয়েছে বলে জানা গেছে।

করোনা আক্রান্ত বাবাকেও রিজেন্টে ভর্তি করেননি সাহেদ। রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের বাবাও করোনা আক্রান্ত হন। তবে তাকে রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে ভর্তি করানো হয় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। বিষয়টি জানা যায়, এই হাসপাতালের একজন সাবেক কর্মীর মাধ্যমে। তিনিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি রিজেন্ট হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছেন আগেই। তাকে ফোন দিয়েছিলেন মো. সাহেদ। তিনি প্লাজমা দেয়ার আবেদন জানিয়ে ছিলেন তার কাছে। তবে রক্তের গ্রুপ না মেলায় তিনি প্লাজমা দিতে পারেননি। এ ছাড়াও নিজের ফেসবুক ওয়ালে বাবার জন্য বি পজিটিভ প্লাজমার জন্য আবেদন করে পোস্টও দিয়েছিলেন সাহেদ। তিনি ওই কর্মীকে জানিয়েছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে তার বাবা চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //