টেস্ট কম রোগীও কম, কোয়ারেন্টিনেও হচ্ছে না টেস্ট

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে বিদেশিরা চলে যাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে। নিজ দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি সংক্রমিত, তারপরও তারা বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। 

বাংলাদেশে সাকুল্যে ৬১ জন নিশ্চিত করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। সে তুলনায়  যুক্তরাষ্ট্রে দেড় লাখেরও বেশি নিশ্চিত সংক্রমণের রোগী থাকলেও বাংলাদেশে বসবাসরত মার্কিন নাগরিকরা নিজ দেশেই চলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কয়েকজন মার্কিন নাগরিকও রয়েছেন, যাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন এখানে রয়েছেন। 

বাংলাদেশে সংক্রমণের হার কম হওয়া সত্ত্বেও তারা কেন চলে যাচ্ছেন? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক মাইক্রোবায়োলজিস্ট অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদের কথা থেকে। 

তিনি বলেন,  ‘আমরা এটা বলতে পারি না যে, ২৪ ঘণ্টায় কেউ আক্রান্ত হয়নি। বরং আমাদের বলা উচিত যে আমরা ২৪ ঘণ্টায় নতুন কোনো রোগী শনাক্ত করতে পারিনি। এর কারণ হচ্ছে এখানে টেস্ট কম করা হচ্ছে।’ 

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) হটলাইনে দৈনিক তিন থেকে চার হাজার ফোন কল আসে। অনেকেই চান যেন তাদের টেস্ট করা হয়; কিন্তু আইইডিসিআর টেস্ট করে থাকে বেছে বেছে। দেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে এখন দৈনিক মানুষ মারা যাচ্ছে; কিন্তু আইইডিসিআর এসব মৃত্যুকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। সে কারণে এসব মৃত্যু সন্দেহজনকের তালিকায়ই থাকছে।

বাংলাদেশে কি তথ্য গোপন করা হচ্ছে?

বাংলাদেশে কি তথ্য গোপন করা হচ্ছে? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন সে তথ্য সারাবিশ্বের মানুষ জানে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রীও আক্রান্ত হয়েছেন বলে ট্রুডো নিজেই ঘোষণা দিয়ে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। 

সর্বশেষ ভিডিও কনফারেন্সে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পরোক্ষাভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তিনি কোয়ারেন্টিনে আছেন তবে তিনি আক্রান্ত নন। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয় সম্পর্কে জানান, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি বড় মন্ত্রণালয়। এখানে প্রতিদিন অনেক মানুষের আসা-যাওয়া রয়েছে। অতএব, এ মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ আক্রান্ত হতেই পারেন।’ 

আরো বড় ঘটনা হলো স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন সন্দেহে টেস্ট করিয়েছেন। এই তথ্যটিও স্বাভাবিকভাবে সংবাদমাধ্যমে আসেনি, কিংবা দেশের জনগণ জানতে পারেনি। প্রশ্ন করে সাংবাদিকদের জেনে নিতে হয়েছে। প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, তিনি টেস্ট করিয়েছেন। তার মধ্যে করোনাভাইরাস নেই; কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কারা আক্রান্ত হয়েছেন ভাইরাসে, সে তথ্য জনগণ জানতে পারেনি; যদিও ব্রিটেন ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর তথ্য মুহূর্তেই সে দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে।  

মানুষ কি সরকারি ভাষ্য বিশ্বাস করে না?

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে মৃত্যু হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে এসব খবর আসছে; কিন্তু আইইডিসিআর তাতে পাত্তাই দিচ্ছে না। এসব মৃত্যু তারা পরীক্ষা করে দেখছেও না। ফলে ভাইরাসটি বাংলাদেশে কী পর্যায়ে ছড়িয়েছে, তা সঠিকভাবে জানাও যাচ্ছে না। 

‘সঠিক তথ্য না পেলে গুজবের ডালপালা ছড়ায়। মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়।’ এমনটাই বলছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। 

তিনি আরো বলেন, ‘যখন যে তথ্য আসে, তা জনগণকে জানিয়ে দেয়াই উত্তম।’ বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিদিন কয়েক হাজার নতুন আক্রান্তের নাম তালিকায় যোগ হলেও, বাংলাদেশে ২৮ ও ২৯ মার্চ নতুন করে কোনো আক্রান্তের তথ্য নেই। গত ৩০ মার্চ মাত্র একজন আক্রান্তের খবর দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে ওইদিন করোনাভাইরাস আক্রান্ত চারজন রোগী সুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। 

এটা ভালো খবর যে, আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। গত ২৯ মার্চ পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে রাখা হয় ৫৩ হাজার ৪৪২ জনকে; কিন্তু তাদের অনেকেই কোয়ারেন্টিনে থাকেননি। বরং নিজের মতো করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এর ফলে কয়েকটি এলাকা লকডাউন করা হয়। তবে সবাইকে পরীক্ষা করে না দেখায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার অবকাশ নেই।

সাধারণ মানুষ টেস্ট করাতে পারছেন না

সাধারণ মানুষ নিজের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখে সন্দেহবশত টেস্ট করাতে চাইলেও তাদের টেস্ট করানো হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরকারি প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ। বেসরকারি পর্যায়ে কেবল মহাখালীর আইসিডিডিআরবিকে করোনাভাইরাস টেস্ট করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাও তারা নিজের মতো করে টেস্ট কিট আমদানি করতে পারছে না। 

আইইডিসিআর তাদের ১০০ কিট দিয়েছে। এর বাইরে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে টেস্ট করানো যায় না; যদিও ঢাকার বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার সামর্থ্য রাখে, তাদেরও পিসিআর মেশিন রয়েছে। ফলে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানেই যেতে হবে; কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিত না হয়ে টেস্ট করাতে চাইছে না। যদিও ভিআইপিদের জন্য এটা মানা হচ্ছে না। এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা কি বেশি

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ২৯ মার্চ ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তা অনেক উন্নত দেশেও নেই। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আড়াইশ’ ভেন্টিলেশন মেশিন নিয়ে এসেছি এবং আরো সাড়ে তিনশ’ আসবে।’ ভেন্টিলেশন কাজে লাগে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের শ্বাসকষ্ট হলে।

দেখা যাক, অন্যান্য দেশে কী রকম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ কোটি মানুষের জন্য ভেন্টিলেটর রয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার। ব্রিটেনের সাড়ে ছয় কোটি মানুষের জন্য আট হাজার ১৭৫টি,  ফ্রান্সের সাত কোটি মানুষের জন্য রয়েছে ছয় হাজার ৬৫টি, কানাডার চার কোটি মানুষের জন্য রয়েছে পাঁচ হাজার, ইতালির সাড়ে ছয় কোটি মানুষের জন্য রয়েছে পাঁচ হাজার, জার্মানির আট কোটি মানুষের জন্য ২৫ হাজার ও রাশিয়ার সাড়ে ১৪ কোটি মানুষের জন্য রয়েছে ৪০ হাজার ভেন্টিলেশন মেশিন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //