‘লকডাউনে’ বিপর্যস্ত খেটে খাওয়া মানুষ

নভেল করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্য সংক্রমণ ভয়াবহ হওয়ার পর থেকেই অথনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পুরো অর্থনৈতিক কাঠামো ও কার্যক্রম একেবারে থমকে গেছে। অঘোষিত লকডাউনে সবকিছুই বন্ধ। করোনাভাইরাসের ক্ষতিতে পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। শিল্পপতিদের নীতিগত নানা ছাড়ও দেয়া হয়েছে। তবে এর বাইরে রয়ে গেছে অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল খেটে খাওয়া মানুষের এক বিশাল অংশ- সারাদেশের রিকশাচালক, দিনমজুর, হোটেল শ্রমিক, হকার, কুলি, গৃহশ্রমিকসহ অসংখ্য পেশার মানুষ। দিন আনে দিন খায়- এসব মানুষের বসবাস বস্তিতে অথবা খোলা রাস্তার ধারে। তাদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সাহায্য ঘোষণা করেনি সরকার বা কোনো সংস্থা।

১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো। ঢাকায় তাদের অন্ন জুটবে না- বাস্তবিক এমন ভয় থেকে ঝুঁকি নিয়েই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা। মাওয়া, পাটুরিয়া, যমুনা সেতু, কমলাপুর স্টেশন- রাজধানী থেকে বের হওয়ার সব পথে ব্যাপক জনসমাগম। তাদের যেতেই হবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও মরবে, না হলেও না খেয়ে মরবে!

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রভাবে চলমান সংকটকালে সাধারণ মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য ফান্ড তৈরির উদ্যোগ জরুরি। এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে সাধারণ মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার বিষয়ে। দিনমজুর, সাধারণ মানুষ- যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের সহায়তা করতে হবে আগে। সাধারণ মানুষ যাদের খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা আছে, তাদের খাওয়ানোটা এখন টপ প্রায়োরিটি। স্বাস্থ্যসেবাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু করোনাভাইরাস না, অন্যান্য রোগীর চিকিৎসাও এখন হুমকির মুখে পড়ে গেছে। ডাক্তারদের নিজের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী নেই বলে করোনাভাইরাসে না যত রোগী মারা যাচ্ছে, হার্ট অ্যাটাকসহ বিভিন্ন অসুখে চিকিৎসা না পেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে বেশি।’

তিনি আরো বলেন, ‘বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ধনীদের সুবিধা দেয়ার সময় এটা নয়। রফতানিমুখী শিল্পে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ক্ষুদে ও মাঝারিদের জন্য সহায়তা বেশি জরুরি।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান মাত্র ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যমতে, অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ৮৬.২ শতাংশ। বাকি কর্মসংস্থান আনুষ্ঠানিক খাতেই হয়ে থাকে। মোট পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ লোক কর্মে নিয়োজিত। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ২৩ লাখের কর্মসংস্থানই অনানুষ্ঠানিক।

আনুষ্ঠানিক কর্মংসংস্থান সাধারণত কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নির্দেশ করে। নিয়মিত মজুরি, নিয়োগপত্র, চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকে এতে। অন্যদিকে, অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান এক ধরনের দুর্বলতা নির্দেশ করে। অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বলতে ঠিকা কাজ, স্বকর্মসংস্থান, দৈনন্দিন মজুরিভিত্তিক কাজ, বিনা পরিশোধের পারিশ্রমিক শ্রম প্রভৃতিকে বোঝানো হয়। অঘোষিত লকডাউনের এই সময়ে তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের সামান্য খাবারের নিশ্চয়তা নেই। স্বাস্থ্য বা অন্য সেবা তো অনেক দূরের কথা!

অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের অনেকেরই বসবাস বস্তিতে। কেউ বা আছেন খোলা রাস্তায়, রিকশা গ্যারেজে, গণপরিবহন স্ট্যান্ডগুলোতে। সরকারি হিসাবে রাজধানী ঢাকার তিন হাজার ৩৯৪টি বস্তিতে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ বসবাস করেন। ২০১৪ সালে বিবিএসের করা প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে বস্তির সংখ্যা এক হাজার ৬৩৯টি। এসব বস্তিতে চার লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন মানুষ বসবাস করেন। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক হাজার ৭৫৫টি বস্তিতে এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন বসবাস করে।

রাজধানীর কড়াইল বস্তির জামাইবাজার এলাকার ছোট্ট একটি টিনশেড ঘরে থাকেন গৃহশ্রমিক শিউলি বেগম। স্বামী, মেয়ে আর ক্যান্সারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে তার সংসার। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় আট দিন আগে শিউলিকে কাজে যেতে না করে দেন গৃহকর্ত্রী। এ অনিশ্চয়তার মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি স্বামী কামালের রোজগারও। দেশব্যাপী অঘোষিত লকডাউনের ফলে নতুন বিপত্তিতে পড়েছে কামাল-শিউলির পরিবার। পুরো পরিবার ঘরবন্দি। এ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। ঘরে চাল নেই। বাইরে বের হলে পুলিশের তাড়া।

শিউলি বেগম বলেন, ‘করুনা (করোনা) ভাইরাসের লেইগ্যা ঘন ঘন হাত ধোওনের জন্য চার দিন আগে বস্তির মোড়ে স্যারেরা একটা বেসিন বসাইছে, দুইডা সাবান দিছে। সেইডা শেষও হইয়া গেছে। শনিবার ১০ টাকা দামের এক প্যাকেট বিস্কুট দিছে হক কোম্পানি। হেরা কি বুঝে না, আমাগো প্যাট আছে! খালি হাত ধুইলেই কি প্যাট ভরবো? সাবান না দিয়া আমাগো ভাত দেন ভাই। নাইলে করুনায় না মরলেও অভুক্ত থাইকা মরতে হইবো।’

রাজধানীর আরেক বস্তি রূপনগরের চলন্তিকা। এখানকার বাসিন্দা বৃদ্ধা বানু, গার্মেন্টসকর্মী পলি ও তাসলিমা, চায়ের দোকানদার ইব্রাহীমসহ অনেকেই জানালেন, তারা গৃহবন্দি। পুলিশের কারণে বস্তির বাইরে যেতে পারেন না। ঘরে এক বেলার খাবারও নেই। তারা অভিযোগ করেন, ‘এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারিভাবে কেউ আমাদের সাহায্য করতে আসেনি। ভাতের ব্যবস্থা না করে সরকার আমাদের ঘরে বন্দি করে রাখল- এটা কেমন মানবতা?’

নিত্যদিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল আরেকটি বড় শ্রেণি গণপরিবহনের চালক ও শ্রমিকরা। অঘোষিত লকডাউনের কারণে পরিবহন খাতের লাখ লাখ চালক ও শ্রমিক এখন কর্মহীন। গণপরিবহন বন্ধ। পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে সরকারের নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও বন্দর, গার্মেন্টস ইত্যাদি বন্ধ থাকায় অধিকাংশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চলছে না। তাই পণ্যবাহী যানের চালক-শ্রমিকদের অনেকেই এখন বেকার; কর্মহীনতার কারণে তারা পড়েছেন নিদারুণ অর্থ সংকটে। অচলাবস্থা আরো দীর্ঘায়িত হলে না খেয়ে থাকতে হবে, এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছে তাদের দিন।

পরিবহন মালিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানিয়েছেন, শ্রমিকদের রোজ খোরাকি বাবদ ৩০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। বেতনভুক্ত চালকরা মাসের নির্ধারিত বেতন পাবেন। তিনি আরো বলেন, ‘যারা বেতনভুক্ত নয়, তাদেরও খোরাকি দেয়া হচ্ছে।’ 

তবে শ্রমিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘৩০০ টাকা খোরাকি দেয়া হচ্ছে, সত্যি। তবে গুটিকয় শ্রমিককে, যারা রাত-দিন বাসে থাকছেন, পাহারা দিতে, শুধু তাদেরই এই টাকা দেয়া হচ্ছে। সেই ৩০০ টাকার মধ্যে দুই আড়াইশ টাকা আবার চলে যাচ্ছে ওই শ্রমিকের তিন বেলার খাবারে। তার পরিবার কী খাবে?’

ওসমান আলী আরো বলেন, ‘প্রতিটি বাসে চালক, সুপারভাইজার, হেলপারসহ সর্বনিম্ন তিনজন শ্রমিক কাজ করেন; কিন্তু পাহারার কাজে রাখা হয়েছে একজনকে। বাকি দুজনকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই দুজন তো কিছুই পাচ্ছেন না। তারা কী খাবেন?’

মহাখালী টার্মিনালে দেখা গেছে, অন্তত হাজারখানেক বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি বাসে পাহারায় আছেন একজন করে শ্রমিক। টার্মিনালের ভেতর অলস সময় কাটাতে দেখা যায় চালক-শ্রমিকদের। ঢাকা-নেত্রকোনা রুটের শাহজালাল পরিবহনের চালক নাসির উদ্দিন এবং আশিক পরিবহনের চালক রেজাউল করিম জানান, ‘বাস চললে তারা দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করেন; কিন্তু এখন বাস বন্ধ থাকায় ১০ দিনের জন্য সাকুল্যে দুই হাজার টাকা মালিকের কাছ থেকে পাবেন খোরাকি বাবদ। অর্থাৎ দিনে ২০০ টাকা। এ টাকায় তো একজনেরই খাবার খরচ হয় না। পরিবারের বিষয় তো পরে। সংসার চলছে অল্প জমানো যে টাকা আছে, তা দিয়ে।’

করোনাভাইরাসের কারণে ‘লকডাউন’ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তা হলে তাদের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়বে। মালিক যে পকেট থেকে টাকা দিচ্ছেন, তা তারা বোঝেন। ‘চালক-শ্রমিকরাই তো গাড়ি চালান, তারাই তো শ্রমে-ঘামে মালিককে ধনী করেছেন। এখন যদি মালিক তাদের না দেখেন, তা হলে তারা কোথায় যাবেন?’ প্রশ্ন রাখেন তারা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //