অস্বীকার, ভয় ও একনায়কতন্ত্র: করোনাভাইরাস বিপর্যয়ে মিসর

বিশ্বের প্রতিটি দেশ করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মহামারিতে হিমশিম খাচ্ছে। কেউ স্বীকার না করলেও এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা আজকের বাস্তবতা। 

প্রথমদিকে চীন, ইতালি বা ইরান কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তা ইতিমধ্যে হাজারো মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। তবে মিসরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে অস্বীকার, গ্রেফতার ও ভীতিকর পরিস্থিতি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির একনায়কতন্ত্রকেই আরো স্পষ্ট করেছে। 

সরকারি হিসাব মতে, দেশটিতে ১ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের পর ২৩ মার্চ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬৬ জন; এতে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। তবে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

ফেব্রুয়ারিতেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রসঙ্গে উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশটির বিশেষজ্ঞরা; কিন্তু তখন কোনো কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে অস্বীকার ও স্বৈরতন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল সিসি সরকার।

মধ্য ফেব্রুয়ারিতে মিসরে ভ্রমণ করা পর্যটকদের অন্তত ৯৭ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কর্তৃপক্ষ স্বীকার না করলেও মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনবহুল এই দেশে করোনাভাইরাস ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। 

বিমান পরিবহন ও ভ্রমণের তথ্য এবং সংক্রমণের হার পর্যালোচনা করে তারা জানান, মিসরে ইতিমধ্যে অন্তত ১৯ হাজার ৩১০ জনের মধ্যে এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য সহায়তা না পাওয়ায় তা শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি। 

কানাডীয় গবেষকদের ওই প্রতিবেদন নিয়ে খবর প্রকাশ করায় যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের কায়রো প্রতিনিধি রুথ মাইকেলসনের প্রেস অনুমতি কেড়ে নেয়া হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের ব্যুরো প্রধান ডিক্লান ওয়ালশ ওই প্রতিবেদনটি টুইট করেছিলেন। পরে টুইট বার্তা সরিয়ে নেয়ায় তার বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নিলেও এ ধরনের কাজকে ‘পেশাদারিত্বের পরিপন্থী’ বলে সমালোচনা করা হয়। 

এখানেই শেষ নয়। করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে সরকারি অব্যবস্থাপনা ও অস্বীকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত সাত মিসরীয়কে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ দেয়া হয়। গ্রেফতার ব্যক্তিদের সম্পর্কে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করে, তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য। 

মানবাধিকার সংগঠন ইজিপ্ট ওয়াচ এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার এখন ক্ষুব্ধ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে- গলা টিপে ব্যর্থতার হিসাব বন্ধ রাখা।

অনেক ক্ষেত্রেই আক্রান্তদের কোনো চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সব লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে গেলেও তাদের সাধারণ রোগীদের সাথেই চিকিৎসা করা হচ্ছে। সেইোথে কর্তৃপক্ষ ভয় দেখাচ্ছে, যদি তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্তের কথা অন্যদের জানান, তাহলে রোগী ও তার পরিবারকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। 

অস্বীকার ও ভয়

একটি প্রমোদতরীতে ৪৪ জন আরোহীর শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর লাক্সর শহরে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কায়রো ও কিনা নগরী থেকে বিশেষজ্ঞ দল পাঠানো হয় পরীক্ষা করতে। তারা হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিশৃঙ্খলভাবে শ্রমিক ও অতিথিদের পরীক্ষা করতে শুরু করেন; আর শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভীতি- করোনাভাইরাস ও প্রশাসনের।

এ প্রসঙ্গে ম্যানচেস্টার থেকে আসা ব্রিটিশ পর্যটক মাইকেল জানান, ‘আমরা ঘুম থেকে ওঠে দেখি, সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা হোটেলের দরজা বন্ধ করছে। তারা জানান, সবাইকে পরীক্ষার পরই আমরা সেখান থেকে বের হতে পারব। পরে দেখলাম, তারা শুধু কয়েকজন মিসরীয়কেই পরীক্ষার জন্য রাজি করতে পেরেছিলেন। চার ঘণ্টা পর তারা চলে যায়।’

অস্বীকার, ভয় ও লোক দেখানো তৎপরতাই যেন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া! গত বছর পর্যটন খাত থেকে মিসরের আয় ছিল সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর আগে ২০১১ সালের আন্দোলন ও ২০১৫ সালে রুশ বিমান বিধ্বস্তের পর পর্যটন খাত বন্ধ করা হয়। তখন ব্যাপক আর্থিক সংকটে পড়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। আর এ জন্য শুধু সরকারই নয়, সংশ্লিষ্ট অনেকেই আক্রান্তের বিষয়টি চেপে যাচ্ছেন।

বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য খাত

বাস্তবতা হলো, ভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই মিসরের স্বাস্থ্য খাত যেনতেনভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) গত বছরই সতর্ক করেছিল, কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়লে তা সামাল দেয়ার সক্ষমতা মিসরের স্বাস্থ্য খাতের নেই। মিসরের বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই সরকারি পদে থেকেও বেশি লাভের আশায় প্রাইভেট হাসপাতালে প্র্যাকটিস করেন।   

ভাইরাস সংক্রমণের খবর আসার পর লাক্সর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার করীম আল-শামস বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের করোনাভাইরাস চিকিৎসার বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। যেখানে সাধারণ সার্জারির ব্যবস্থাপনাই ঠিকমতো নেই; সেখানে কোনো প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বিধান ছাড়াই একটি ভীষণ সংক্রামক ভাইরাসের সামনে আমাদের যেতে বাধ্য করা হয়। আমরা অসংখ্য রোগী পেয়েছি, যাদের করোনাভাইরাসের লক্ষণ রয়েছে। তাদের অ্যান্টিবায়োটিক ও জ্বরের ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হয়েছে। জরুরি বিভাগে ১০০ রোগীর ব্যবস্থাপনা থাকলেও, সেখানে লাইনে রয়েছেন আরো ৩০০ রোগী।’ 

একই অবস্থা মিসরের কারাগারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বন্দি রয়েছে কারাগারগুলোতে। নেই ভালো স্যানিটেশন, চিকিৎসা, বা খাবারের ন্যূনতম মান। যেন এক মৃত্যুপুরী! কারাগারে সাধারণ বন্দির চেয়ে বেশি রয়েছে রাজনৈতিক বন্দি। ভিন্নমত দমনে মিসরের সামরিক শাসকরা বরাবরই কারাগারকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। 

২০১৫ সালে প্রকাশিত মিসরের ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর হিউম্যান রাইটসের এক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশটির থানাগুলোতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ বেশি বন্দি রয়েছে, আর কারাগারে রয়েছে দেড়গুণেরও বেশি বন্দি। রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। অভিযোগ রয়েছে, জরুরি ওষুধও দেয়া হয় না রাজনৈতিক বন্দিদের, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হয় কারাগারে। মিসরের কারাগারগুলো হতে পারে কভিড-১৯ সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।

সিসির পরিকল্পনা

মাসখানেক অস্বীকারের পর সম্প্রতি মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দুই সপ্তাহের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে করোনাভাইরাস বিরোধী কার্যক্রমে ১০০ বিলিয়ন মিসরীয় পাউন্ড (প্রায় ৬৪ বিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ ঘোষণা করেন। তবে এবারও বরাদ্দের বেশিরভাগ অর্থই যাবে মিসরীয় সেনাবাহিনীর পকেটে। কার্যত নাগরিক পরিষেবা খাতের বড় অংশীদারিত্বই সেনাবাহিনীর হাতে। যেখানে সেনাবাহিনী জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকার কথা, সেখানে মিসরে জনগণই সেনাবাহিনীর সেবায় নিয়োজিত। 

করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অস্বাস্থ্যকর কারাগার থেকে বন্দিদের সাময়িক মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা। 

গত ১৮ মার্চ একটি প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে প্রখ্যাত উপন্যাসিক আহদাফ সোয়েফসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। কার্যত মানবিক আবেদনে করা সমাবেশেও সিসি যেন মুসলিম ব্রাদারহুডের ছায়া দেখতে পান!

বিপর্যস্ত অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সিসির বন্ধুর সংখ্যা এখন নিতান্তই নগণ্য। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ সামনে তলানিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। করোনাভাইরাসের ফলে মিসরের অন্যতম প্রধান বিদেশি মুদ্রা উপার্জনকারী পর্যটন খাতে ধস নামতে বাধ্য। বিশ্ব অর্থনীতি আক্রান্ত হলে সুয়েজ খালকেন্দ্রিক উপার্জনও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। শুধু সৌদি আরবেই প্রায় ২০ লাখ মিসরীয় কর্মরত রয়েছেন। 

উপসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতি এ ভাইরাসের ধাক্কায় পর্যুদস্ত; তাই ওই প্রবাসী শ্রমিকরা কাজ হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। মিসরে কোনো বৃহৎ শিল্পোৎপাদন নেই। এসবের ফলে সার্বিকভাবে দেশটির অর্থনীতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। 

অপরদিকে, আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দেশটির সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক একনায়ক হিসেবে নিজেকে ইতিহাসের পাতায় তুলে ধরছেন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //