এ্যান্টিগনি: ভালোবাসার শ্বাশত প্রকাশ

‘এ্যান্টিগনি:  চল, মৃতদেহটা তুলতে সাহায্য করবি!
তুই আর আমি...!
ইজমিনি: তার মানে? কবর দিতে! রাজাজ্ঞার বিরুদ্ধে?
এ্যান্টিগনি: তোর ভাল লাগুক আর না লাগুক, সে কি তোর আর আমার ভাই নয়? আমিতো তাকে কোন মতেই ত্যাগ করতে পারি না!’ (পৃষ্ঠা-১২)

উপরের বাক্যালাপটি গ্রীক ট্রাজেডির এ্যান্টিগনি ও ইজমিনির। যেখানে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে এ্যান্টিগনির ভাতৃপ্রেম উঠে আসছে চূড়ান্তরূপে।

প্রাচীন গ্রিক নাট্যকারদের অন্যতম সফোক্লিস। তাঁর লেখা নাটক বিয়োগান্তক ধারার। তিনিই বিয়োগান্তক ধারার প্রবর্তক।  তাঁর লেখা জনপ্রিয় নাটকগুলো সারা পৃথিবীর মঞ্চে শত শত বছর ধরে মঞ্চস্থ হয়ে আসছে আজও। এথেন্স নগর রাষ্ট্রে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর যে নাট্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত, প্রায় ৫০ বছর ধরে সেই প্রতিযোগিতায় বিয়োগান্তক নাটকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তম স্থানটি সফোক্লিসের জন্যই বরাদ্দ। যদিও তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সম্ভবত ১২৩টি নাটক রচনা করেছিলেন, সময়ের পরিক্রমায় এর মধ্যে মাত্র ৭টি পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় আমরা দেখি। এছাড়াও তাঁর লেখা অনেকগুলো নাটকের কিছু কিছু অংশ উদ্ধার হয়েছে।


সারা পৃথিবীর নাটকের বিকাশের ক্ষেত্রে সফোক্লিস সূর্যসম, তাঁর অবদান এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে মূল্যায়িত হয়ে থাকে। তাঁর লেখা নাটকেই আমরা প্রথম কোনো তৃতীয় চরিত্রের দেখা পাই। এছাড়া নাটকে কোরাসের ভূমিকাও তিনি-ই সংকোচন করেন। অবশ্য সফোক্লিস যেভাবে নাটক রচনা করতেন এর ফলে তার নাটকের ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে কোরাস পূর্বেকার গুরুত্ব অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। এবং তাঁর নাটকের চরিত্রও পূর্ববর্তী নাট্যকারদের তুলনায় অনেক বেশি বিকশিত হয়ে প্রকাশ পায়। গ্রিক এই মহান নাট্যকার তাঁর দীর্ঘ ৯০ বছরের জীবনে সারা পৃথিবীর নাট্যজগতকে নতুন করে দেখার সুযোগ তৈরি করে গিয়েছেন, যা তাঁর লেখা নাটকের মধ্যে দিয়ে প্রতি মুহূর্তে প্রকাশ পায়।

সফোক্লিস রচিত ‘এ্যান্টিগণি’ নাটকটি গ্রিক ট্যাজেডি সাহিত্যে ও সারা পৃথিবীর নাট্যসাহিত্যে এক অন্যতম নিদর্শন। যেখানে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকার সুন্দর ও সরল প্রকাশ, মৃত্যুর শীতলতা যার উষ্ণতম আবেদনকে হেয় করতে পারেনি সামান্যতম।

মানব প্রজ্ঞার ঊষালগ্ন থেকে সাহিত্য মাধ্যম হিসাবে নাটকের উত্থানকাল খুব বেশি দূর নয়। প্রাচীন গ্রীসে যে নাট্যকলার প্রাথমিক স্ফুরণ ঘটেছিলো তা আজ সমগ্র পৃথিবীতে আদৃত। আজ যে নাট্যকলা মানুষের আনন্দদানের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে পরিগণিত, সেই সময় তা ছিলো মানব মনের জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়ার এক মাধ্যম। অনন্ত জিজ্ঞাসা আর ভয়মিশ্রিত বিমূঢ়তা নিয়ে মানুষ সমস্ত অশুভ দুর্দৈবকে বুঝতে চেষ্টা করেছে, নিজের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত ঐ সমস্ত ঘটনার পেছনকার চালিকাশক্তির উপর আরোপ করেছে দেবত্ব আর তাদের তুষ্ট করে ঐ সকল দুর্বিপাক থেকে নিজেদের রক্ষায় আয়োজন করেছে যাগযজ্ঞ, হোমাগ্নি আর নিবেদিত নৃত্যগীতি।


‘এ্যান্টিগনি’ হতভাগ্য রাজা ঈদিপাসের কন্যা। ঈদিপাসের দুঃখময় প্রস্থানের পর তার কন্যাদ্বয় ও পুত্ররা হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন, যেন সারেং বিহীন এক জাহাজ, কোথায় তার গন্তব্য- জানা নেই। তারই এক পুত্র দেশদ্রোহী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুর পরও সমাহিত হবার সম্মান থেকে বঞ্চিত, অপরপক্ষে আরেকজন রাজকীয় সম্মানে সাড়ম্বরে সমাহিত হয়। কিন্তু বোনের হৃদয় দুই ভাইয়ের জন্য পূর্ণ আবেগে পরিপূর্ণ থাকায়- এক ভাইয়ের সম্মান, আর অপরজনের অপমান যেনে নিতে অপারগ। তাই তো সে নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছিলো- ‘কিন্তু এই নিষিদ্ধ কাজ আমি আর কারো জন্যই করতাম না। আমার স্বামী পুত্র থাকলে তাদের জন্যেও না, কেননা এক স্বামীকে হারালে অন্য স্বামী পেতে পারি, তার দ্বারা অন্য সন্তানও। কিন্তু মা-বাবার মৃত্যুর পরে আরেকজন ভাই কোথায় পাব।’একদিকে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর রাজা ক্রেয়ন-অন্যদিকে নিজের ভাইয়ের মৃতদেহ! এই অবস্থায় তাই ভয়ংকর রাজআজ্ঞা উপেক্ষা করে এ্যান্টিগনির পলিনিসাসকে মর্যাদাপূর্ণভাবে সমাহিত করতে হাত সামান্যতম কাঁপেনি, বোন ইজমিনির মত সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেনি। অপরিসীম ভালোবাসায় সিক্ত করেছে ভাই-বোনের সম্পর্ক ও দায়বদ্ধতাকে।

খুব সাধারণও চিরায়ত এক সম্পর্ক কিন্তু এ্যান্টিগনির অপরিসীম সাহস ও ভাইয়ের প্রতি অভিন্ন ভালোবাসা এবং তার জন্য নিজের প্রেম ও জীবনের মায়া ত্যাগ এই নাটককে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা ও ট্যাজেডির এক নতুন আবহ, যেখানে প্রেম আছে, অন্যায় অবিচার আছে কিন্তু সে প্রেম কেবল নিজ স্বার্থের ক্ষেত্র দ্বারা আবদ্ধ ও পরিচালিত নয়। বরং কর্তব্যবোধের দীপ্তিতে প্রজ্জ্বলিত এক আলো যা সবার হৃদয়ে ভালোবাসা জাগাতে সক্ষম। তাইতো শেষ পর্যন্ত ইজমিনিও এগিয়ে এসেছিলো ভাইয়ের প্রতি, বোনের প্রতি ভালোবাসার টানে। কিন্তু নাট্যকার এখানেও দেখিয়েছেন এ্যান্টিগনির এক চারিত্রিক প্রকাশ, যে বলতে পেরেছিলো- ‘যার ভালোবাসা শুধু কথা, তেমন বন্ধুকে আমি ভালোবাসিনে।’ অর্থাৎ কেবল কথার ফুল্গধারায় ভালোবাসার প্রকাশই কোন কিছুর শেষ নয়, বরং প্রতিটি ভালোবাসার যে চাহিদা, প্রতিটি ভালোবাসার যে দাবি তা পূরণও তার অবিচ্ছেদ্য কার্য। তাইতো এ্যান্টিগনির ভালোবাসার পথে সহযাত্রী তার ভালোবাসার মানুষ মানবতাবাদী প্রেমিক-হীমন।



এটি সুন্দর এক উপাখ্যান, যেখানে হতাশা আছে, বেদনা আছে কিন্তু আছে এমন এক প্রজ্জ্বলিত আশা ও ভালোবাসা, যে সকল রূঢ়তা, অন্যায়, একচ্ছত্রতাকে অতিক্রম করে চিরায়ত সম্পর্কের এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এইভাবেই চলতে থাকবে। শত বাঁধা, শত অন্যায় সে শাশ্বত ভালোবাসার সীমানা কখনোই অতিক্রম করতে পারবে না।

সবশেষে এ্যান্টিগনির ভালোবাসা সম্পর্কে একটি বাক্য পুনঃস্মরনীয় বলেই মনে করি- যা ধ্রুব এবং শাশ্বত 
‘...জীবিতকে ভালোবাসার কাল তো ক্ষণিকের, মৃতকে ভালোবাসার কাল অন্তহীন!’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //