এস এম সুলতান: বাংলার চিত্রশিল্পের কালপুরুষ

‘আদম সুরত’ (THE INNER STRENGTH)- বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে ক্ষণজন্মা এক নক্ষত্র- চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক, গীতিকার প্রয়াত তারেক মাসুদের প্রথম প্রামাণ্য চিত্র। 

‘আদম সুরত’ হলো আকাশের একটি তারামণ্ডল, যাকে আমরা কালপুরুষ হিসেবে চিনি। এই কালপুরুষ দেখে নাবিকেরা তাদের পথ ঠিক করে। তারেক মাসুদ এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে। এস এম সুলতান ছিলেন বাংলার এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তিনি শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে পরিচিত ছিলেন। 

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বায়োগ্রাফিকাল সেন্টার সুলতানকে ‘ম্যান অব এচিভমেন্ট’ সম্মাননায় ভূষিত করে। তার আঁকা ছবি স্থান পেয়েছে পিকাসো, সালভাদর দালির মতো শিল্পীদের সাথে একই প্রদর্শনীতে। তিনি শুধুই যে চিত্রশিল্পী ছিলেন তা নয়, অদ্ভুত ছিল তার জীবন ধারণের উপায়। নিজের শিল্পের প্রতি সৎ থাকার জন্য ছেড়েছেন আরাম, আয়েশ ও বিলাস। কখনো বিয়ে করেননি তিনি।

প্রামাণ্যচিত্রটির নাম আদম সুরত রাখা হয়েছে রূপক অর্থে, যাতে সুলতানের জীবন আদর্শ দেখে মানুষ নিজেদের হারিয়ে যাওয়া জীবনবোধ ফিরে পায়।

১৯৩০ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছুমদিয়া গ্রামে সাধারণ এক কৃষক পরিবারে জন্ম হয় শেখ মোহাম্মদ সুলতান ওরফে লাল মিয়ার। বাবা শেখ মেসের আলী কৃষিকাজের এর পাশাপাশি ঘরমির কাজও করতেন। অর্থনৈতিক দৈনতার জন্য লাল মিয়া একমাত্র সন্তান হওয়া স্বত্বেও পঞ্চম শ্রেণীর পর আর এগুতে পারেননি! সেই সময়ে তাকে তার বাবার সহযোগী হিসাবে কাজে যেতে হতো আর তখন তিনি সুযোগ পেলেই কাঠ কয়লা দিয়ে ছবি আঁকতেন! মাঝে মাঝে রঙিন রং ব্যবহার করতেন পাঁকা পুঁইয়ের রস আর কাঁচা হলুদ দিয়ে (পরবর্তীকালেও যখন তিনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন, তখন এসব ভেষজ রং এর প্রতি তার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল)।

ছবি আঁকার প্রতি তার এই আগ্রহ চোখে পরে স্থানীয় জমিদার ধীরেন্দ্র নাথ রায়ের, তিনি লাল মিয়াকে ভর্তি করে দেন নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে।এস এম সুলতান এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। এরপর স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরে বাবার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি সেই দালানগুলোর ছবি আঁকতেন। ৮ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময় ড. শাম্যপ্রসাদ মুখার্জ্জী স্কুল পরিদর্শনে এসে তার আঁকা ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল ছবি আঁকা শিখবেন। এজন্য প্রয়োজন হলে কলকাতায় যাবেন। কিন্তু এরকম আর্থিক সঙ্গতি তার পরিবারের কখনোই ছিল না।

১৯৩৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ না হতেই তিনি ছবি আঁকা শেখার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। কলকাতায় গিয়ে উঠলেন নড়াইলের জমিদারদের বাড়িতে, সেখানে জমিদারের ছোট ভাই তার ছবি আঁকার আগ্রহ দেখে তাকে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করে দেন। সুলতান ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেও ম্যাট্রিক পাশ না করার কারনে ভর্তি আটকে গেলো! তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালায়ের ভাইস চ্যান্সলের ও বিশিষ্ট শিল্পবোদ্ধা শাহেদ সোহাওয়ার্দীর বিশেষ সুপারিশে তিনি আর্ট স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেলেন।

শুরু হলো তার দ্বিতীয় অধ্যায়। এরপর সব শিল্প অনুরাগীরা যখন মোটামুটি তার দক্ষতায় মুগ্ধ তখন তিনি আরেকবার শিক্ষা জীবন শেষ না করেই সব ছেড়ে ঘর পালালেন…..আর এবার ঘুরে বেড়ালেন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে।

তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, সুলতান পাঁচ/দশ টাকার বিনিময়ে ভিনদেশি সৈনিকদের ছবি আঁকতেন। তিনি সে সময়ে ছবি একেই জীবিকা চালাতেন, তাই তার এই সময়কার আঁকা কোনো ছবি আর পাওয়া যায়নি।

এই সময়ে তিনি আবার নাচ শেখাও শুরু করেছিলেন, তখন তিনি থাকতেন কাশ্মীরে। ১৯৪৬ এর পরে তিনি চলে যান পাকিস্তানে।

বিভিন্ন লেখা পত্র থেকে জানা যায়, তার বিচিত্র জীবনের খণ্ডিত কিছু অংশ সম্পর্কে। বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পীকে নিয়ে, তার জীবন ও কর্ম নিয়ে এতো তোলপাড় করা ইতিবাচক ও নেতিবাচক তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। গভীরতর রহস্যের ধূম্রজাল যাকে নিয়ে, তিনি আসলে একজন সহজ মানুষ ছিলেন। নিজের মতো, সযতনে অন্যের আরোপিত সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন আর ছবি এঁকেছেন।

সুলতানের ব্যক্তিজীবনের সাথে শিল্পীজীবনের সমান অগ্রগতি আমরা দেখি না। তার মন-মগজে বড় হতে থাকা মানুষ আর সমাজভাবনা সব ছবিতে দেখা যায়। কোনো ব্যাকরণনির্ভর সৃষ্টিকর্ম তিনি তৈরি করেননি। ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন খাকসার আন্দোলনে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন দেশে। সে-সময়কার আঁকা ছবির মাঝে প্রকৃতির ছবি তিনি বেশি এঁকেছেন। সিমলায় প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে। 

কখনো রাধা, কখনো কৃষ্ণ সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছেন। অর্থাৎ পারফর্মিং আর্ট, যা একবিংশ শতকে বাংলাদেশে অনেক শিল্পীই চর্চা করেন, সুলতান বহু আগেই তা শুরু করেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-ছায়াতল থেকে ভারত ভ্রমণ এবং সিমলা, কাশ্মীর হয়ে পাকিস্তানের করাচিতে প্রদর্শনী করেছেন। পাকিস্তানভিত্তিক একটি পত্রিকায় পাওয়া যায় এর প্রমাণ। অতঃপর মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র এবং শুরু হলো ইউরোপ ভ্রমণ। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তার একক প্রদর্শনী হয়। পরবর্তীকালে লন্ডনের হ্যামস্টিভ ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে সে সময়ের এমনকি বর্তমান সময়ের প্রতিভাধর-ক্ষমতাধর পাবলো পিকাসো, দালি, ব্রাক, ক্লি প্রমুখ শিল্পীর সাথে সুলতান প্রদর্শনী করলেন। দেশে ফিরেও কিছু প্রদর্শনী করলেন জার্মান কালচারাল সেন্টার, শিল্পকলা প্রভৃতি গ্যালারিতে। 

সফল প্রদর্শনী; কিন্তু কোনো সফলতাই সুলতানকে বাঁধতে পারল না। তিনি চাইলেই বিত্তশ্রেণিতে চলাচল করতে পারতেন। বরং চলে গেলেন নড়াইলে। লাল মিয়ার নড়াইলে সুলতান গড়লেন শিশুস্বর্গ। চিড়িয়াখানা ও একটা পুরো অঞ্চলের মানুষের চেতনাগত শিল্পবোধে ঘটে গেল আশ্চর্য বিপ্লব। সুলতান ছবি এঁকে, শিল্পের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে অঞ্চলের কৃষক-শ্রমিককের মধ্যে শ্রেণিবিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন চেতনাগত পরিমন্ডলে। জাতির শেকড় ও ভবিষ্যৎ অর্থাৎ কৃষক ও শিশুরা ছিল তার মূল মনোযোগ ও সকল দায়িত্বশীলতায়। 

সুলতানের বৈচিত্র্যময় জীবন, প্রজ্ঞা, রহস্যময়তা ও জীবনদর্শন সে সময়ে অনেক অনুরাগী তৈরি করলো। অধিকাংশ অনুরাগী ছিলেন চারুকলাজগতের বাইরের মানুষ। কারণ তার যথেচ্ছচারী জীবন সুশীল নগরের শিল্পীদের অনেকের জন্যই বিরক্তির কারণ ছিল। অধ্যাপক আবুল কাসেম জোয়ার্দারের সাথে ১৯৫০-৫১ সালের প্রথম দিকে, মানে প্রায় ৬৪ বছর আগে সুলতানের পরিচয়। এখন শতবর্ষ ছুঁইছুঁই এই মানুষটি সুলতানের সাথে প্রায় ৩০ বছর সাপ-খোপের নির্জন ঝোপ-জঙ্গলের ঘরে একত্রে কাটিয়েছেন। তখন কাসেম সাহেব যশোরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক। বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে ‘Unseen Splendour’ (অদেখা সুষমা) শিরোনামে যে ড্রইং-প্রদর্শনীটি গত ২১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়, সেটি আবুল কাসেম জোয়ার্দারের কাছে থেকে যাওয়া সুলতানের ড্রইং খাতায় আঁকা শিল্পকর্ম।

১৯৫৩ সালে নড়াইলে তিনি ফিরে এসে আবার দেশে-বিদেশে আসা-যাওয়ার মাঝে নিজেকে ছবিতে যুক্ত রাখেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রদর্শনী থেকেই বাংলাদেশের মানুষ সুলতানের ছবি আঁকার বিষয় ও মাধ্যম সম্পর্কে জানতে পারে।

সুলতানের ড্রইংগুলো শক্তিশালী রেখা ও রেখার গতিতে। এগুলো দ্রুত আঁকা। নারী ও পুরুষ চরিত্র, প্রাকৃতিক দৃশ্য, ফুল-লতাপাতা ও পশুর ড্রইংগুলো অধিকাংশ চারকোল মাধ্যমে আঁকা কিছু জলরং, কলমের টোনের কাজ ও কিছু পেনসিলে করা ছবি আছে। ছবিগুলোতে সুলতানের পেইন্টিংয়ের পেশিবহুল নারী-পুরুষ নেই। কিন্তু রয়েছে ‘পেশিবহুল’ আঙ্গিকের উৎস। ড্রইংগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কোনো পূর্ণাঙ্গরূপ নেয়নি। কুইক ড্রইংয়ের এমন বৈশিষ্ট্য স্বীকৃত। কিন্তু এই ড্রইংগুলোতেও মৌলিকত্ব দৃশ্যমান। ভারতীয় অঞ্চলের কলা ব্যাকরণের সাথে এর সাযুজ্য বিদ্যমান। এসব ড্রইংয়ের অন্তর্গত বস্ত্তগুলোর গঠন, মহিলাদের সুগঠিত শারীরিক গঠন, রেখার ছন্দ, অসম্পূর্ণতাও রহস্যময়ভাবে দেখা যায়।

আমাদের জন্য কষ্টকর এই যে, সুলতান শিল্পকর্ম সযতনে রাখার ব্যাপারে কখনোই মনোযোগী ছিলেন না। তাই তার জীবনের একটা বড় সময়ের (চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের) শিল্পকর্মের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এ প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের জন্যে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ প্রদর্শনীর ছবিগুলো প্রথমবার প্রদর্শিত হয ও পঞ্চাশের দশকের সুলতানের সাথে এগুলোর কথোপকথন ঘটে।

সুলতান তার ছবি-আঁকা নিয়ে কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের সাথে আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘না, শুধু প্রকৃতি নয়, প্রকৃতির বিচিত্র রূপ আমি North Western Front-এও দেখেছি। তবে কাশ্মীরে আমাকে টানলো কাশ্মীরি জীবনটা। পরিশ্রমী জীবন। আমার মনে হলো, তাদের এই hardship-টা বাঙালিরাও করে। খুব ভালো লাগতো আমার ওই কাজের মানুষগুলোকে আর মানুষগুলো খুবই সরল। তাছাড়া প্রকৃতি তো আছেই।’ 

সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুলতানের ঢাকায় বসবাস করার আয়োজন হয়েছিল। আবাসিক শিল্পী ঘোষণা করলেন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার– এসব কিছুই সুলতানকে প্রকৃতির কাছ থেকে ফেরাতে পারেনি। তার পোষা প্রাণী, ষড়ঋতুর দেখা পাওয়া যায় এমন প্রকৃতির সন্ধান পেতে নড়াইলের চিত্রা নদীর তীরে তিনি ফিরে এলেন। নাগরিক হতে সুলতানের ভালো লাগেনি।

বিখ্যাত এই চিত্রকর চেতনায় ছিলেন ব্যক্তিস্বাধীন ও প্রকৃতিগতভাবে ছিলেন ভবঘুরে ও ছন্নছাড়া। প্রকৃতিকে তিনি সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন একই সাথে যান্ত্রিক নগর জীবনকে ঘৃণা করেছেন। এস এম সুলতানের কাছে আধুনিকতা কেমন ছিলো এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘তার কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি, তার আধুনিকতা ছিলো জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই ও ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তার কাছে ছিলো 'আধুনিকতা', অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।’

সুলতানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, নিজ দেশ ও জাতি নিয়ে এক হিমালয়সম গর্ব, সাধারণ মানুষকে নিয়ে তার দুর্নিবার অহংকার, ভালবাসা, মমত্ববোধ পাশাপাশি সমাজের অন্যায়ের প্রতি প্রচণ্ড প্রতিবাদ, ক্ষোভ, আন্দোলন তার তুলির পরশে বিশাল বিশাল ক্যানভাসে জীবন্ত রুপায়িত হয়েছে। বিষয়বস্তুতে গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমিক, কৃষাণ, এদেশের কাদাজলের সাথে যাদের আত্মিক সম্পর্ক, যাদের রুটি-রুজির উৎপত্তি স্থল সেই মাঠ, প্রান্তর, সবুজ ধানক্ষেত, যেখানে জমি কর্ষণরত চাষী, রাখালেরা বাঁশীর সুরে মগ্ন, জেলে মাছ ধরায় ব্যস্ত, গৃহস্থালীর কাজে মনোযোগী পল্লীবালা, মাছকোটা, ধানবোনায় ব্যস্ত সুখী পরিবারের চিত্র। কুঁড়েঘর, উঠোন, খড়ের পালা, কলাগাছের সারি, অলস দুপুরে গৃহিনীরা গল্পে ব্যস্ত। গোধূলী বেলায় দূরে কোথাও মেঠোপথে ধূলো উড়িয়ে পল্লী-বধূর বাবার বাড়ি যাওয়ার দৃশ্য। সারি সারি তাল, নারকেল গাছ, বনজঙ্গল, নদীতে পালতোলা নৌকা, মাঝির ভাটিয়ালী সুর, জাল দিয়ে মাছ ধরা, গুনটানায় ব্যস্ত মাল্লা, নদীর ঘাটে কলসীতে জল আনতে গ্রাম্য বধূর সলাজ চাহনী।


তিনি শুধু বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন তাকে বিশ্বজুড়ে কাল্পনিক কৃষিসভ্যতার জনক বলা হয়। তার জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই খেটে খাওয়া কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম ও বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তার শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তার চিত্রকর্মে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণীর দ্বন্দ্ব ও গ্রামীণ অর্থনীতির সংগ্রামীরূপ ফুটে উঠেছে শিল্পীর একান্ত নিজস্ব মহিমায় ও স্বকীয়তায়। তার ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে ও কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। 

তার জীবনকে কৃষি এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি শেষ জীবনে তার পরিপূর্ণতা নিয়ে এইভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন- ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে’।

এস এম সুলতানের আঁকা ছবিগুলোতে বাঙালি কৃষকদের দৈহিকভাবে একরকম বলিষ্ঠ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং চিত্রকর বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা...। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। দেশের অর্থবিত্ত ওরাই যোগান দেয়। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিৎ।’

তার চিত্রগুলোতে সুডৌল ও সুঠাম গড়নে গ্রামীণ নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি যেন নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপলাবণ্যের সাথে শক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছেন। একই সাথে তার ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রুর বাস্তবতা উঠে এসেছে। তার এরকম দুটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) ও চরদখল (১৯৮৮)।

১৯৮৭ সালে আঁকা ‘শিরোনামহীন’ ছবিতে ঘরের দাওয়ায় বসে একজন নারীর আরেক নারীর চুল আঁচড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বৈচিত্র্য আছে। নারীর দেহ সুঠাম, হাত ও পায়ে মোটা ধাতব চুড়ি পরা। শরীরে পেঁচানো শাড়ি অনেকটা অগোছালো। ঘরের চালায় ত্রিভুজাকৃতির উপস্থিতি। ছবির সম্মুখভাগে বড় স্পেসে মেটে হলুদ রঙের উঠান। বাঁদিকে গাভির কাছে কিষানি দুধ দোহন কাজে ব্যস্ত। গরু, কিষানি ও দুই নারী প্রত্যেকের চাহনিতে শক্তি আর নিশ্চয়তা খেলা করে। সুলতানের আঁকা ছবির এ প্রদর্শনীতে দেখা নতুন কাজের মাঝে দর্শক ভিন্নতা খুঁজে পান এভাবে। রেখাচিত্রে আঁকা ছবিগুলোতে কৃষকের মুখের আকৃতি প্রায় একই ধাঁচের। ধারণা করা যেতে পারে, হয়তো ওই আদলের পুরুষ মডেল দেখে তিনি ছবিগুলো এঁকেছেন।

শিরোনামহীন– ১৯৮৬ ছবিতে বাড়ির আঙিনায় ধানের গোলার আকৃতি অনেকটা জ্যামিতিক ত্রিভুজাকৃতির। বাড়ির আঙিনায় কিষানিরা দল বেঁধে ধান ঝাড়ছে। গোলায় ভরে সারা বছরের শস্য মজুদ করছে। ক্যানভাসের এককোণে গরু গামলা থেকে খাবার খাচ্ছে। পুকুরে সদ্য গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাসের ডগা উঁকি দিয়ে জানান দেয়, প্রকৃতি মাত্র সবুজে ভরে উঠছে। সুলতান এ ছবিতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের জ্যামিতিনির্ভর ক্যানভাস গড়েছেন। এক দেখায় ছবির জমিনে সারি সারি ধানের গোলাকে জ্যামিতিক আকৃতিতে বিন্যস্ত নির্বস্ত্তক ক্যানভাস মনে হয়। সুলতান বিশুদ্ধ বিমূর্ত কথা ও প্রথার বিপক্ষে। তার ক্যানভাসে প্রাণের উপস্থিতি অনিবার্য। রং, রেখা, রূপ, রস, ছন্দ ছবির মৌলিক উপাদানের মাঝে থেকেই মূর্ত করেছেন তার সৃষ্টিকর্ম।

ফুল, বৃক্ষ, নদী-পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক মানুষটির সাথে সখ্য গড়ে ওঠে পশুপাখির। আদিম ঐতিহ্যের সাথে মিলে যায় সুলতানের পশুপাখির সম্পর্ক। জীবন-যাপনের ব্যতিক্রমী ধরন দেখে মানুষের মাঝে কৌতূহল জাগত বটে, কিন্তু সুলতানের ধ্যান তো ছবির ক্যানভাসে। রঙের নিরীক্ষা আর মানুষের দেহভঙ্গির ভাঁজে। আধুনিক আবার ঐতিহ্যিক– এ দুইয়ের মিশেলে সুলতান গড়েছেন তার সৃষ্টিভান্ডার। এ প্রদর্শনীটি বেঙ্গল আর্ট প্রিসিঙ্কট-ডেইলি স্টার গ্যালারিতে শুরু হয় গত ২৩ মে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘পরাদৃষ্টি’। প্রদর্শিত ছবিগুলো ক্যানভাস ও চটে তেলরং, কাগজে কালি-কলম, জলরং, চারকোলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা। মোট কাজের সংখ্যা ৩৬। বেশকিছু শিল্পকর্ম দর্শক এর আগে দেখেননি। 

বড়মাপের ক্যানভাসগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছবি ‘শিরোনামহীন’ – ১৯৯১ সালে আঁকা। সংঘবদ্ধ হালচাষ বলা যায় এ ছবিকে। সাতজোড়া গরুর সাহায্যে সারিবদ্ধভাবে হালচাষ করছে কৃষক। মেঘলা আকাশ বলে দেয় এ ছবির বিষয়ের কথা। চষাক্ষেতে বৃত্তাকার মাটির ঢেলা এক কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করেছে। ছবির কেন্দ্র নির্ধারণ করে অন্য বিষয়গুলো উপস্থাপিত হয়েছে মনে হলেও দৃষ্টিকে ক্যানভাসের কেন্দ্র থেকে বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল এ-শিল্পকর্মের মূল লক্ষ্য। 

অন্য একটি ছবির শিরোনাম – ‘আনটাইটেলড’ – ১৯৮৯ সালে ছবিটি আঁকা। আশির দশক-পরবর্তীকালে সুলতানের ছবির বিষয়ে কর্মচঞ্চল মানুষ, ঘরবাড়ি, গাছপালা সমানভাবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা জনপদের দিনযাপন সমতলে থাকা মানুষের চেয়ে ভিন্ন। এ ছবিতে আকাশ আর নদীর নীল জল একাকার হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতের শেষ বিন্দুতে গিয়ে মিলে যায় আকাশ আর নদী। কৃষক তার হালের গরু গোসল করাচ্ছে। কৃষকের মাংসপেশি টান-টান। নদীর ঘাটে অন্য পাশে স্নান করছে নারী ও শিশুরা। শিশুরা নগ্ন। নারীরা স্বল্পবসনা। সুলতান মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাখঢাক ছবিতে প্রকাশ করেননি। আদিম মানব শরীরের গড়ন তুলে আনেন ছবির বিষয়ে। তাই তো ছবি হয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিক কথন। 

কাগজে জলরঙে আঁকা আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হচ্ছে হার্ভেস্টিং – হালচাষের গরু নিয়ে কৃষক লাঙল-কাঁধে মাঠে যাচ্ছে। পাশে লাজুক গাঁয়ের বধূ নদীতে জল আনতে যাচ্ছে। নদীর নীল জল থেকে ফসল তুলছে আরো দুজন কৃষক। সুলতানের এ ছবিও জৌলুসপূর্ণ আবেদন জাগায় না। দ্রোহ কিন্তু শক্তি আর সামর্থ্যের ঘোষণা দেয় বারবার।

শিল্পবোদ্ধাগন বিভিন্ন সময়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন, একবার তাকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সোনারগাঁওয়ের এক পুরানো ভবনে স্টুডিও করে দেয়া হয়, আরেকবার ঢাকার মিরপুরে তার পছন্দ অনুযায়ী সরকারি খরচে বাড়ি ভাড়া করে দেয়া হয়। কিন্তু নাগরিক জীবন কখনোই তার ভাল লাগেনি। কিছুদিন থেকেই অস্থির হয়ে যেতেন গ্রামের নিভৃত জীবন আর পোষা পশুপাখির সাহচার্যের জন্য।

পার্থিব সম্পদের প্রতি চরম উদাসীন এই শিল্পী যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ছবির যাদু চালিয়ে যেতে পারেন, সে কারণে তাকে বাংলাদেশের ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’ ঘোষণা করা হয়েছিল অর্থাৎ সরকার তার ছবি আঁকার সকল সরঞ্জাম আর টাকা দিতো, বিনিময়ে বছরে ছয়টা ছবি তাকে দিতে হবে শিল্পকলা একাডেমিকে। এত কিছু করেও অবশ্য তাকে ইটকাঠের জঙ্গলে অভ্যস্থ করা গেলো না।

সুতরাং এক সময়ে দেখা গেলো ঢাকা ছেড়ে আবার তিনি চলে গিয়েছেন নড়াইলে, এবার গিয়ে এক জমিদারের ভাঙ্গা বাড়িতে উঠলেন। সেখানে দ্বোতালার যে ঘরটিতে তিনি থাকতেন সেখান থেকে অন্য কামড়ায় যাবার বারান্দার মাঝখানটা ছিল ভাঙ্গা, উপরে ছিল না ছাদ, একদম শিল্পীর মতোই খেপাটে।

এর মাঝেই তিনি তার দত্তক পরিবার, কিছু পায়রা, মুরগি, বিড়াল, সাপ আর পাখি নিয়ে খুব আনন্দে থাকতেন। তার বিবাগীমন এতই সংসার বিমুখ ছিল যে সহজে কারো সাথে দেখা করতে চাইতেন না।

পরবর্তীকালে যশোরের সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি তাকে তিন কামরার একটা সুন্দর বাড়ি করে দিয়েছিল, সেখান তিনি চলে আসেন। এই বাড়িতে ‘শিশুস্বর্গ’ নামের ব্যতিক্রমী একটা স্কুল আর ছোট-খাট একটা চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছিলেন। 

তিনি বলতেন, “আমাকে অনেকে বলেন, আপনি শহরে থাকলে উন্নতি হতো। শহরে থাকলে আমরা আরো কিছু আশা করতাম। আমি দেখি আমাদের গ্রামের মানুষগুলো হাঁটে-বাজারে গিয়ে তাদের সাথে একটু আলাপ ব্যবহার যা পাই নিঃসঙ্গ অনুভব করি না আমি। সেখানে আমার এপ্রেসিয়েটরস বেশি। গ্রামে একটি সহজ সুন্দর মানুষ যেভাবে ছবিকে পছন্দ করে সে এপ্রেসিয়েশন আমি কোথাও পাই না। তার একটু লাউয়ের মাচার ছবি আঁকলে বলে যে এটি আমার লাউয়ের মাচা। তার দুটো বলদের ছবি আঁকলে সে কত খুশি হয়। তাতে আমার মনে হয় যে আমি অনেক সুখেই আছি গ্রামে।”

সুলতান ছবি আঁকার উপরে আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা সম্পূর্ণ করেনি, তিনি তার গভীর দৃষ্টি দিয়ে আধুনিক শিল্পগুরুদের কাজের অনুকৃতি দেখেছেন! শুধু মাত্র পেনসিল আর তুলি দিয়েই তিনি কোনক্রমে জীবন ধারণ করেছেন, বাণিজ্যিক কোনো কাজে তিনি কখনো হাত দেননি, যদিও তার সামনে সুযোগ ছিল প্রচুর। যার ফলে সারা জীবন মোটামুটি দারিদ্রতার সাথে তিনি বসবাস করেছেন, মাঝে-মধ্যে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন আবার সাথে সাথে বেহিসাবীও হয়েছেন।

গুণী এই চিত্রশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর, নড়াইলে, ৭১ বছর বয়সে। শেষ বয়সে তিনি শিশু শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেছিলেন যা নিয়ে তার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল। তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ ও চারুপীঠ নামে দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় তোলেন। এছাড়া সেখানে ‘নন্দন কানন’ নামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ‘নন্দন কানন স্কুল অব ফাইন আর্টস’ নামে একটি আর্ট স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন।

মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সৃজনশীল। প্রত্নতত্ত্ববিদগণের আবিষ্কারে প্রাচীন যুগের মানুষের অঙ্কিত গুহাচিত্র এবং পশুর হাড় ও শিং থেকে নির্মিত মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তিসহ বিবিধ শিল্পনিদর্শনের দেখা মেলে। ধারণা করা হয়, শিল্পকলার উদ্ভব হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে। ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ মানুষ তার চারপাশে যা দেখেছে তা-ই তার শিল্পমাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করে গেছে।

একজন শিল্পী, কবি বা সৃজনশীল যেকোনো মানুষ নিজের ভেতর যুগপৎ ধারণ করে সাধারণ ও অসাধারণ দুটি সত্তা। সাধারণ সত্তাটি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মতো জীবনচক্রের অমোঘ নিয়মে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে অসামান্য সত্তা আমৃত্যু মগ্ন থাকে আত্মানুসন্ধানে। দুটি সত্তার পার্থিব ও অপার্থিব প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশ ও অন্তর্দ্বন্দ্বও কম নয়। বস্ত্তত আত্মানুসন্ধানের যাতনায় মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠে। যাতনা থেকেই উদ্ভূত হয় প্রকৃত শিল্প।

শিল্পীর সৃজন প্রধানত তার নিজের জন্য। শিল্পকর্ম গ্যালারিতে প্রদর্শিত হওয়ার পর তা শিল্পীর ব্যক্তিগত সীমানা পেরিয়ে জনসাধারণের হয়ে ওঠে। দর্শক, সংগ্রাহক ও শিল্পবোদ্ধা মারফত শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় ও ইতিহাসে স্থায়ী ব্যাপ্তি পায়।

সুলতান একটি সত্যের ধারক। বাংলাদেশ তথা এ-উপমহাদেশে বাঙালির জীবন-যাপন, সংগ্রাম, দিনপঞ্জি তার মননে প্রোথিত ছিল। নিরন্তর সংগ্রামমুখর আবহমান বাঙালি কৃষকের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ সুলতানের সঙ্গী হয়েছিল। নাগরিক হতে চাননি কখনো। তার মগজে প্রতিনিয়ত খেলা করেছে বাঙালির বৈরী পরিবেশের সাথে সংগ্রাম, মধ্যযুগের সামন্তপ্রভু, পর্যায়ক্রমে ইংরেজ, পাকিস্তানি এবং পরবর্তীকালে স্বদেশীয় শোষক শ্রেণির উপর্যুপরি শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষকের শরীরে শুধু অবশিষ্ট মাংসহীন দেহের কথা। সুলতান এ-পীড়নে অতিষ্ঠ কৃষক নিয়ে আস্থা হারাননি। 

তিনি বিশ্বাস করেছেন, আমার কৃষক লাঙল-কাঁধে মাঠে গিয়ে জমি কর্ষণ করে যে ফসল ফলায় তাতে আমাদের দেশ ধনধান্যে-পুষ্পে ভরে ওঠে। সুলতান ভাবেন, কৃষকের সংগ্রাম অদম্য। কৃষকরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চষে শুধু ফসল ফলায় না। মাংসল পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মায়ায় জড়ায়। স্নেহ, প্রেম আর সঙ্গমে প্রকৃতিকে ফুলে-ফলে ভরে তোলে। ক্যানভাসে প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ মানুষের উপস্থিতি দর্শককে চমকে দেয়। 

সুলতান শুধু কি কৃষকের কথা বলেছেন? না, তার বোহেমিয়ান জীবনের নানা বাঁকে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময়কালে আঁকা দুটি ছবি এ প্রদর্শনীতে দেখা যায়। লাহোরে অবস্থানের সময় পাকিস্তানের এ অঞ্চলের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে তেলরঙে আঁকা এ ছবি দুটিতে বাংলাদেশের বাইরের পরিবেশের চর্চার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে। সুলতানের ছবিতে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, যোদ্ধা, হাজির হলেও রঙের প্রয়োগে তিনি সাবধানি ছিলেন। অস্পষ্ট, ঝাপসা, কুয়াশাচ্ছন্ন, অবগুণ্ঠিত অতীতের কথা রঙে প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের ছবির দর্শকদের মাধ্যমে সুলতান মনের ভেতরে থাকা ইচ্ছাশক্তিকে প্রকাশ করেছেন। গ্রামবাংলার তন্ময় হয়ে থাকা রূপ-রসে বিভোর সুলতান দর্শকদের মনে করিয়ে দেন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর চিরযৌবনা বাংলাকে। আমাদের সভ্যতার মূলে রয়েছে কৃষিজীবী মানুষের লড়াই। এককভাবে সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করে কিষান আর কিষানি। সুলতানের ছবিতে বারবার হাজির হয় কৃষক আর আকাশের ধোঁয়াচ্ছন্ন মেঘের সাথে রক্তিম আভা। মর্তলোকের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষ কোনো কোনো কাজে ঊর্ধ্বাকাশের সাথে যোগসূত্র তৈরি করে। মহাকালের কাছে কৃষিজীবী, সুফলা বাংলার দায় শোধ করে সুলতানের কৃষক আনন্দ উদযাপন করে। মাটি ও মানুষের সাথে এ সম্পর্ক বাংলার মানুষের প্রাণে প্রোথিত। এ এক শক্তি আর সৃষ্টিশীলতার উদযাপন। সুলতান সৃষ্টি করেন বলশালী মানুষ আর মাটি-কর্ষণে ফেঁপে-ওঠা মাটির ঢেলা, যা থেকে উদ্গারিত হয় বপন করা বীজ। এখানেই বাঙালির সফলতা। 

স্বদেশ, অধিকার, প্রকৃতি, দ্রোহ, সংগ্রাম, তৃণমূল মানুষের দিনযাপনের মুহূর্তকে ছবির বিষয় করে নিয়ে এস এম সুলতান আমাদের জানিয়ে দেন, আমরা আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের পথ বেয়ে আজকের আধুনিক বাঙালি সমাজ নির্মাণ করেছি। জঙ্গম জীবনের দেবদূতরূপী মানুষের অবয়ব ক্যানভাসে তুলে এনে শস্য-শ্যামল, সুফলা, বাংলাদেশের কথা ঘোষণা করেছেন। 

এস এম সুলতানকে নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক। সুলতানকে অনেকে প্রান্তিক শিল্পী ও অনেকে তার শিল্পকর্মের গুণ বিচার করেন তাকে নেইভ (বন্য) বলে। আবার সুলতানের মৌলিকত্ব নিয়ে আহমদ ছফা বলেন, ‘তবু তাদের কোনো পূর্বসূরি নেই, নেই কোনো উত্তরসূরি। আচমকা জলতল থেকে সুবর্ণস্তম্ভের মতো উত্থিত হয়ে দণ্ডায়মান হয়ে রয়েছে।’ 

নানা মুনির নানা মত থাকবেই। কিন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা থেকে দূরে সুলতান তার একান্ত নিজস্ব শৈলী ও বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি এঁকেছেন এবং প্রতিটি ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষকে নিয়ে তার নানা স্বপ্ন। তার হাতেই বাংলাদেশের প্যাস্টোরাল শিল্পের পুনরুথ্থান ঘটেছিল।

প্রথমে তারেক মাসুদের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার নির্মিত সেই প্রামাণ্যচিত্রের কথা দিয়েই এই প্রবন্ধের অন্তর টানবো। ‘আদম সুরত’ বাংলাদেশী আধুনিক চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘তারেক মাসুদের’ ১৯৮৯ সালের একটি প্রামাণ্যচিত্র। সুলতানের দৈনন্দিন কর্মজীবন তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি ও কৃষিচিত্র উপস্থাপনা করা হয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্রে।

তারেক মাসুদ তার চলচ্চিত্রযাত্রা গ্রন্থের শুরুর দিকে ‘আদম সুরত’ নিয়ে লিখেছেন, “ছবিটির একটা কাঠামো চিন্তা করে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। সুলতান তো গণমাধ্যম বা ক্যামেরার সামনে আসতে রাজি হতেন না। তবে শেষ পর্যন্ত যে শর্তে রাজি হলেন তা হচ্ছে, তিনি যেন ছবির প্রধান বিষয়বস্তু না হন। তিনি বললেন, ‘আমি বরং নিমিত্ত, আমাকে উপলক্ষ্য করে আপনারা বাংলার কৃষকের ওপর ছবি বানান। আমি আপনাদের সাথে ক্যাটালিস্ট হিসেবে থাকবো’। তার নির্দেশনা আমাদের জন্য এ রকম পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়, আমরা সুলতানের সাথে ঘুরব ও তার সঙ্গে গ্রামীণ বাংলাকে দেখবো।” 

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে তরুণ এই নির্মাতা সুলতানের কথার সাথে সুর মিলিয়ে শুরু করেছিলেন তার প্রামাণ্যচিত্রটির কাজ। সুলতান যেমন প্রবাসী জীবন থেকে ফিরে নাগরিক ব্যস্ততাকে পাশকাটিয়ে সাধারণ গ্রামীণ কৃষকের জীবনকে, যারা বলতে গেলে রীতিমতো যুদ্ধ করেই উৎপন্ন করে আমাদের জন্য, তাদের জীবন ও তাদের কৃত্য, তাদের উৎসব, তাদের সংস্কৃতি তথা বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে করে নিয়েছিলেন তার চিত্রকলার বিষয়বস্তু। তাই ‘আদম সুরত’ চলচ্চিত্রটি চিত্রায়িত করতে গিয়ে উঠে এসেছে চিত্রা নদীর পাড়ের তথা বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির রূপ।

আমরা সমস্ত চলচ্চিত্রটি জুড়েই দেখতে পাই চলচ্চিত্রকার ছবিগুলো সাজিয়েছেন লোক ঐতিহ্যের রঙে, চিত্রশিল্পী সুলতানের দর্শনের সাথে মিল রেখে। যদিওবা কাজের শুরুতে তারেক মাসুদ কোনো লিখিত ধরাবাঁধা চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেননি, চলচ্চিত্র জীবনে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //