মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও কথাসাহিত্য

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনার সঙ্গে এতটাই গভীরভাবে মিশে গেছে যে, বাংলাদেশে যারাই লেখালেখি করছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধকে চেতনে কিংবা অবচেতনে এড়িয়ে যেতে পারেন না। কোনো না কোনোভাবে তাদের লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ আসবেই, গল্প-উপন্যাস, কবিতা-গান, ছড়া, নাটক-প্রবন্ধে কিংবা স্মৃতিচারণায়।

এখন প্রশ্ন হলো মুক্তিযুদ্ধ যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা যতোটা সহজে সেই রক্তাক্ত সময়, সেই সময়ের মানুষের উত্তাপ, স্বাধীনতা স্পৃহা, জীবনবোধ, স্বদেশ চেতনা, আবেগ-উৎকণ্ঠা, বেঁচে থাকার আকুতি ও লড়াই, জটিল মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি শব্দের তুলিতে চিত্রিত করতে সক্ষম হবেন, মুক্তিযুদ্ধ যারা দেখেননি কিংবা দেখলেও কিছু মনে নেই, কিংবা স্বাধীনতার অনেক পরে যাদের জন্ম, এই সময় কিংবা আরও পরে যারা জন্মগ্রহণ করবেন, তারা কি তাদের মতো ইতিহাসের এই স্পর্শকাতর বিষয় সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে পারবেন?

কারণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পঠন অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ জ্ঞান মানুষের অনুভূতি লোকে নিশ্চয় সমানভাবে তীব্রতা ছড়ায় না। এ নিয়েও তর্ক বিতর্ক হতে পারে। পৃথিবীতে অনেক ভালো ভালো কথাসাহিত্য আছে, যা ঐতিহাসিক ঘটনার শত বছর পরেও রচিত হয়েছে। বর্তমানে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। পঠন অভিজ্ঞতা, কল্পনাশক্তি ও লেখার ক্ষমতাই লেখককে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে দেখার ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করার স্পর্ধা জুগিয়েছে।

শওকত ওসমান (জন্ম জানুয়ারি ২, ১৯১৭, মৃত্যু মে ১৪, ১৯৯৮), আনোয়ার পাশা (জন্ম এপ্রিল ১৫, ১৯২৮, শহীদ ১৯৭১), সৈয়দ শামসুল হক (জন্ম ডিসেম্বর ১৯৩৫, মৃত্যু সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৬), মাহমুদুল হক (জন্ম ডিসেম্বর ১৬, ১৯৪০, মৃত্যু জুলাই ২১, ২০০৮) সেলিনা হোসেন (জন্ম জুন ১৪, ১৯৪৭-),  হুমায়ূন আহমেদ (জন্ম নভেম্বর ১৩, ১৯৪৮, মৃত্যু ১৯ জুলাই ২০১২) একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই জন্মগ্রহণ করেছেন। বর্বর পাকিস্তানি হায়েনাদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণের অনেক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী; কিন্তু আনিসুল হক (জন্ম মার্চ ৪, ১৯৬৫-) মুক্তিযুদ্ধের মাত্র কয়েক বছর আগে জন্মেছেন। যুদ্ধের সুস্পষ্ট স্মৃতি তাদের কারো মনে থাকার কথা নয়।

আনিসুল হকের হয়তো কিছু কিছু স্মৃতি ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়তে পারে। কিন্তু তার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার উপন্যাস রয়েছে। শওকত ওসমানের জাহান্নাম হইতে বিদায়, নেকড়ে অরণ্য, দুই সৈনিক, আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরত, সৈয়দ শামসুল হকের নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া, দেয়াল, আগুনের পরশমণি ইত্যাদি উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের মর্মবেদনার অনেক চিত্র ভাস্বর হয়ে ওঠে।

এসব উপন্যাস কল্পনাশ্রয়ী; বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধ বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন নয় মোটেও। নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক হায়েনারা কীভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে হত্যা করেছিল, কীভাবে লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন করে দৈহিক ও মানসিকভাবে বিকল করে দিয়েছিল, যুদ্ধের নির্মম ক্ষত শরীরে ও মনে তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে সারাটি জীবন, দুঃসাহসী বীর বাঙালিরা কীভাবে পাকদের প্রতিরোধ করে হটিয়ে দিয়েছিল, তাদের প্রতিরোধ ও যুদ্ধকৌশল এবং আত্মত্যাগের চিত্র আমরা এসব উপন্যাসে দেখতে পাই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের প্রত্যক্ষিত জীবন ও সমাজ এবং অগ্নিগর্ভ সময় ধারণ করে নির্মিত হয়েছে এসব উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত বাস্তবতা ও সত্য ঘটনা অবলম্বনে নবীন-প্রবীণ রচিত চারটি উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত কথা বলছি- শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসটি ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় বসে লেখা। মে মাসে তিনি সেখানে চলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, চারদিকে জ্বালাও পোড়াও, ঘরবাড়ি লুট করে এদেশকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিল। তাই প্রাণের ভয়ে প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে কলকাতায় পালিয়ে যাচ্ছেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক গাজী রহমান। মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে যেতে তিনি প্রত্যক্ষ করেন পাক বর্বরদের নির্যাতন ও ধ্বংসের জঘন্য চিহ্ন। তার মন ভেঙে যায়। সারাক্ষণ তিনি আতঙ্কে থাকেন। বর্ডারের কাছাকাছি গিয়ে তার মনে হয় তিনি জাহান্নাম থেকে বিদায় নিতে পেরেছেন। উপন্যাসে গাজী রহমান মূলত শওকত ওসমানেরই প্রতিরূপ।

১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন, মাত্র তিন মাসে, তেতাল্লিশ বছর বয়সে, আনোয়ার পাশা রচনা করেন ‘রাইফেল রোটি আওরত’। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে এটিই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস; কিন্তু এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বর্বররা ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। সেই কালরাতের ভোরের বর্ণনা দিয়েই উপন্যাসটির শুরু। শেষ করেন বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়ে। প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির জন্য হিন্দুয়ানী নাম তাকে বদলাতে হয়েছে।

যুদ্ধের সময় তিনি উপলব্ধি করেন, পাকিস্তানিদের ক্ষোভ শুধু হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্টদের ওপর না, বাংলা ভাষার ওপরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দুই ভাই মালেক ও খালেকের পাকিস্তানপ্রীতি ও রাজাকার মানসিকতার নোংরা চিত্র এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। পাকিস্তানপন্থী বা রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও মালেককে হত্যা করে পাকিস্তানি আর্মি। তার স্ত্রী ও কন্যাদের ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। অত্যাচার ও ধর্ষণ শেষে ফেরত পাঠায়। ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেয় তিনশ’ টাকা। তা দেখে মালেকের উৎফুল্ল, ‘আর্মির জেনারসিটি দেখুন, মেয়েদের ফেরত পাঠাবার সময় চিকিৎসার জন্য তিনশ’ টাকাও দিয়েছে। দে আর কোয়াইট সেন্সিবল ফেলো।’

এ ধরনের মানসিকতার লোক বর্তমান সমাজেও বিরল নয়। আনোয়ার পাশা অনুমান করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হবেই। বাঙালিকে কেউ রুখে দিতে পারবে না। কিন্তু বুদ্ধিজীবী নিধনের নীলনকশার তালিকা অনুযায়ী বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে রাজাকার ও পাকসেনারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। আনোয়ার পাশা দৈহিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ও চেতনার শিখা প্রজ্বলিত হয়ে আছে।

মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, আনিসুল হকের মা  উপন্যাসে।

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে সেলিনা হোসেন ১৯৭২ সালে একটি গল্প লেখেন। একটি পত্রিকায় ছাপাও হয় সেই গল্প। সেই গল্পটিকেই রূপ দেন উপন্যাসে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলদিগাঁ গ্রামের কিশোরী বুড়ি। তার চেয়ে বয়সে বেশ বড় বিপত্নীক গফুরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। গফুরের আগের স্ত্রীর সলীম ও কলীম নামে দুটি সন্তান ছিল। বুড়ির ঘরে জন্ম নেয় রইস নামে এক প্রতিবন্ধী ছেলে। তবু ভালোই চলছিল তার সংসার। যুদ্ধে ওলোট-পালট হয়ে যায় তার সংসার। সলীম যায় মুক্তিযুদ্ধে।

পাক সেনারা কলীমকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। সলীম ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে বলে। কলীম কোনো তথ্য না দেয়ায় বুড়ির সামনেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলে পাকিস্তানি আর্মি। বুড়ির চিন্তার জগত পাল্টে যায়। এ কেমন বর্বর মানুষ ওরা? আদৌ কি ওরা মানুষ! নিরপরাধীকে হত্যা করে! তার মধ্যে জেগে ওঠে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধচেতনা। একদিন পাকিস্তানি আর্মিদের তাড়া খেয়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা কাদের ও হাফেজ আশ্রয় নেয় বুড়ির ঘরে। পাকিস্তানি সেনারাও তাদের খোঁজে এসে পড়ে বাড়ি। বুড়ি হয়ে ওঠে বাংলার মা। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের প্রতিবন্ধী সন্তান রইসকে তুলে দেয় বন্দুকের নলের সামনে। হলদিগাঁ হয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রতীক।

আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসটি ২০০৩ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ ও তাঁর মায়ের জীবনের সত্য ঘটনা আনিসুল হক তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। দেশমাতার টানে আজাদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শেষ দিকে তিনি ধরা পড়ে যান পাকিস্তানিদের হাতে। তাকে থানায় নিয়ে টর্চার করা হয় তাঁর সঙ্গীদের নাম বলার জন্য। কিন্তু আজাদ কারো নাম বলেন না। ছেলে ধরা পড়েছে, থানায় আছে, এ সংবাদ পেয়ে তাঁর মা থানায় গিয়ে আজাদের সঙ্গে দেখা করেন। ছেলের খোঁজখবর নেন।

আজাদ বলেন যে, তাকে মাটিতে শুতে দেয়। ভাত খেতে দেয় না। আজাদের মা তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বলতে নিষেধ করে আসেন। পরদিন ভাত রান্না করে নিয়ে যান থানায়। গিয়ে দেখেন তার ছেলে সেখানে নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজাদ আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। তিনি শহীদ হয়েছেন। আজাদের মা কোনোদিন আর খাটে ঘুমাননি, যতদিন বেঁচে ছিলেন, ভাত মুখে দেননি। রুটি কিংবা অন্য কিছু খেতেন। তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর কবরের ফলকে আমার নাম লেখবে না, লেখবে শহীদ আজাদের মা।

উপন্যাসের নানা শিল্পগুণ বিচারে এসব উপন্যাস অনেকভাবেই সমালোচিত হতে পারে; কিন্তু আমাদের কথাশিল্পীরা সেই সময়ের যে ছবি এঁকেছেন, ভাষা দিয়ে গেঁথে ফেলেছেন মানুষের যে জটিল মনোজগত, প্রকৃতি, জীবন ও সমাজচিত্র, তা আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই অসামান্য দলিল। ইতিহাসের এই বাস্তবতা ও সত্য থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হতে পারি না। বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই পাঠমগ্নতা স্বদেশের প্রতি মমত্ব ও দায়িত্ববোধ আরো বাড়িয়ে দেবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //