লোকলজ্জা

কোন দেশের সভ্যতা বা সংস্কৃতি কতটুকু উন্নত বা অনুন্নত হইয়াছে তাহা বুঝিবার জন্য সেই দেশে প্রকাশিত বিশ্বকোষ দেখিবার বিশেষ দরকার নাই। দেশের ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বা স্বল্পায়ু পত্রিকা দেখিয়াও দেশটা কোথায় যাইতেছে তাহা খানিক বোঝা যায়। ‘লোক’ নামক লিটল ম্যাগাজিনটি গত বিশ বছর ধরিয়া গোটা পঁচিশ বার প্রকাশ পাইয়াছে। এই আয়ু নিছক কম আয়ু নহে। এই সংখ্যাগুলির বেশির ভাগই আমি পড়ি নাই। পড়িলে হয়তো একদিন নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিব, ইতিহাস মানে মাত্র অতীতের কাহিনী নহে। অতীত যেভাবে বর্তমানে আসিয়া হাজিরা দেয় তাহাকেই ইতিহাস বলে।

সত্যের খাতিরে স্বীকার করিব, লোকের পঁচিশ বারের মধ্যে মাত্র একবারই আমি চোখে পড়ার মতো একটি লেখা পাইয়াছিলাম। এই একেলা লেখাটির নাম ‘যৎকিঞ্চিৎ বিনয় মজুমদার’। লেখক আহমদ ছফা। ‘লোকের’ আদিপর্বের এক সংখ্যায় (২য় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১) লেখাটি প্রকাশিত হইয়াছিল। আশা করি, অন্যরাও অন্য কোন বারে পড়িবার মতন কোন না কোন লেখা পাইয়া যাইবেন। 

সত্যের খাতিরে আরো একটি কথা এখানে আমার বলিয়া রাখিতে হইবে। ‘লোকের’ শেষ জীবনে আমাকে সম্মান জানাইয়া একটি সংখ্যা (২৪শ সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১৮) ছাপা হইয়াছে। সেই সংখ্যায়ও আমাকে পোড়াচোখ বুলাইতে হইয়াছে। চোখ শুকাইয়া পদ্মা নদী হইয়াছে কিন্তু পড়িবার মতো কোন লেখা খুঁজিয়া পাই নাই। দায় আর দয়া ছাড়া যেন লেখককুলের লিখিবার আর কোন কারণ নাই। এই জাতীয় লেখা হয়তো সকল দেশে সকল যুগেই লেখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই যুগে মনীষার এহেন আকাল, কবিতার এহেন মন্বন্তর কেন?

আমাদের সাহিত্য আর সভ্যতার এই দশা কেন হইল তাহা হয়তো ভবিষ্যতে কেহ না কেহ অনুসন্ধান করিবেন। এই লেখায় সেই অনুসন্ধানের অবকাশ নাই। আমি লজ্জায় বড় অধোবদন হইয়া আজিকার এই লেখায় দস্তখত করিতেছি। আহমদ ছফা ইহকাল ত্যাগ করিয়াছেন আজ আঠার বছরের অধিক হইয়াছে। তাঁহার এন্তেকালের বছর যে শিশু জন্মিয়াছিল সে শিশুটি বাঁচিয়া থাকিলে হয়তো প্রাপ্তবয়স্কই হইবে। দুঃখের মধ্যে, আহা! আমাদের সাহিত্য-সমাজের শিশুভাব আজও কাটিল না। সবিনয় নিবেদন করি, যতদূর চোখ পৌঁছে ততদূর ‘লোক’ পত্রিকার বেশির ভাগ সংখ্যাই দেখিলাম, এই গাঢ়, এই তুমুল সমাচারই বহন করিতেছে। কোথায়ও কোন মনীষার দীপ্তি নাই। কি কবিতায়, কি সমালোচনা নামের ভনিতায়। এ কেমন কাল আসিল রে, বাবা!

এই পোড়াচোখে দেখিতেছি, ‘লোক’ পত্রিকার বিনয় মজুমদার সংখ্যায় আহমদ ছফা যাহা লিখিয়াছিলেন একমাত্র তাহাই ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমই মনে হইল নিয়মটা প্রমাণ করিতেছে। আমাদের লেখকদের কোন লোকলজ্জা নাই। আহমদ ছফার এই প্রাতস্মরণীয় রচনা হইতে খানিক উৎকলন করিয়া লজ্জাকর লেখার ইতিহাস সম্পর্কিত এই লেখার সমাপ্তি টানিব। মহাত্মা আহমদ ছফার লেখাটির শেষাংশ একাংশে এই: ‘আমি আধুনিক কবিতার ঠিক একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম না। অন্য অনেক বিষয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি আধুনিক কবিতাও পাঠ করতাম। তাই কবিতার ভালমন্দ বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কোনো সিদ্ধান্তে আসার মতো একরৈখিক মনোভাবও আমার জন্মাতে পারেনি। তারপরেও বিনয় মজুমদারের কবিতাগুলো পাঠ করার পর আমার মনে হতে থাকল আমার ভেতরে একটা দহনক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই কবির রচনার শরীরে এমন এক ধরনের সুপ্ত আগুন রয়েছে যা আমার মনের ভেতর একটা মৃদু প্রীতিপ্রদ অগ্নিকা-ের সৃষ্টি  করে দিয়েছে।’ (ছফা ২০১১ : ২০৪)

মৃদু প্রীতিপ্রদ অগ্নিকাণ্ডের পটভূমির একটা বর্ণনাও পেশ করিয়াছেন আহমদ ছফা: ‘আমি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। তাঁর কাব্যিক উচ্ছ্বাসের তারিফ করতেও আমার বাধেনি। বিষ্ণু দের কবিতার মর্মগ্রহণ করার জন্য আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। অন্যরকম নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য একসময়ে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ত্রিশের প্রধান কবিদের রচনা পাঠ করার পেছনে যে সময় এবং শ্রম আমি ব্যয় করেছি তার শতাংশের একাংশও বিনয় মজুমদারের জন্য করিনি। দীর্ঘদিন পর আমি যখন কবিতা সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা নিয়ে নাড়াচাড়ার চেষ্টা করছি, আমি বুঝতে পারছি বিনয় মজুমদার আমার মনে একটি বড় জায়গা অধিকার করে বসে আছেন।’ (ছফা ২০১১: ২০৪)

আহমদ ছফার মনের এত বড়সড় তালুক বিনয় মজুমদার কিভাবে দখল করিলেন তাহাও খানিক বিশদ করিয়াছেন তিনি নিজে। এই কারণটা বিনয়ের ‘স্বাতন্ত্র্য’ এবং ‘মৌলিকত্বের’ সহিত জড়িত। সাহিত্যের ইতিহাসে ‘মৌলিকত্ব’ জিনিশটা নিছক কথার কথা নহে। আহমদ ছফা লিখিতেছেন, “কতিপয় কবি রয়েছেন, যাঁরা কবিতার ধারার ভেতর থেকে জন্মান। তাঁদের সাফল্য অল্প হতে পারে কিংবা হতে পারে বেশি, সেটা বড় কথা নয়। কবিতার পূর্বাপর ধারাপরম্পরার মধ্যেই তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতার বিচার করতে হবে। আর কিছু কিছু কবি আছেন চেতনাগত দিক দিয়ে যাঁদের কবি হওয়ার প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ ভিন্নরকমের। তাঁদের স্বাতন্ত্র্য এবং মৌলিকত্ব এত প্রখর যে সেটাকেই তাঁদের চেনার নিশানা হিশেবে গণ্য করা যায়।’ (ছফা ২০১১: ২০৪)

বিনয় মজুমদারের স্বাতন্ত্র্য আর মৌলিকত্বের পেছনে আত্মহত্যার মতন একটি অপ্রীতিপ্রদ অধ্যায়ও আছে। সেই অলিখিত অধ্যায়ের খানিকটা আহমদ ছফাই লিখিয়াছেন: ‘বিনয় নানাগুণে গুণান্বিত পুরুষ। তিনি যদি কবিতা না লিখে অন্যান্য বিষয়ের চর্চা করতেন, আমার ধারণা অনায়াসে সিদ্ধি অর্জন করতে পারতেন। তাঁর নানারকম যোগ্যতা এবং পারঙ্গমতা ছিল। তিনি সব বাদ দিয়ে শুধুই কবিতার সঙ্গে লটকে রইলেন।’ কেন রহিলেন? আহমদ ছফা মনে করেন: ‘একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে সেখানে ভালমন্দ বাছবিচারের প্রশ্নটা গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। কবিতার প্রতি তাঁর আত্যন্তিক প্রেম এবং অনুরাগ বিনয় মজুমদারকে অনেকটা মানসিকভাবে আত্মহননের পথে ধাবিত করে নিয়ে গিয়েছে। অথচ বিনয় যদি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারতেন, তাঁর বিচিত্রমুখী প্রতিভার সম্যক বিকাশ যদি ঘটত, বাংলা সাহিত্য একজন শ্রেষ্ঠ কবিই পেত না শুধু, পাশাপাশি একজন মনীষী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাবেও ধন্য হতে পারত।’ (ছফা ২০১১: ২০৪)

আহমদ ছফা কথা এখানেই শেষ করেন নাই। তিনি আরো মনে করেন: “যে সমাজের মধ্যে বিনয় মজুমদার বসবাস করে আসছিলেন সে সমাজের সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্রের শিকার বিনয়কে হতে হয়েছিল। এটা আপাত-সত্য কিন্তু পুরো সত্য নয়। বিনয়কে নানা কারণে বার বার ঠাঁইনাড়া হতে হয়েছে যা তাঁর সাহিত্যচর্চা নয়, জীবনটাই আগাগোড়া পাল্টে দিয়েছে।’ (ছফা ২০১১: ২০৫) আহমদ ছফার এই মন্তব্যের সবটাই বুঝিয়াছি এমন দাবি আমি করিব না। তবে ‘ষড়যন্ত্র’ কথাটা প্রত্যাহার করিয়া লইলে আমিও কবুল করিতাম প্রভু ইংরেজের বিদায়ের পর দ্বিধাবিভক্ত বঙ্গে যে সাংস্কৃতিক কাঠামো দাঁড়াইয়াছিল তাহাতে প্রতিভা বিকাশের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় পৌঁছিয়াছিল বলিলে বেশি বলা হয় না। প্রসঙ্গত কবুল করিয়া বলি, সেই অবস্থার কোন স্বতন্ত্র বা মৌলিক পরিবর্তন আজও হয় নাই। ইহার মধ্যে ‘লোক’ কিংবা লোকান্তরের কি ভূমিকা বলিবার মতন ভুরিবিদ্যা আমার নাই।

আহমদ ছফা আক্ষেপ করিয়াছেন: ‘শুরুতেই যদি বিনয় একটি সংগ্রামী অবস্থান গ্রহণ করতেন, তাঁকে অভিমানী বালকের মতো জীবনের বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বেড়াতে হতো না।’ আহমদ ছফা মানেন, বিনয় মজুমদারের এই পরিণতির দায় একেলা সমাজের নহে। তিনি যাহা কহিয়াছেন তাহার সহিত দ্বিমত করা সত্যই কঠিন, ‘হ্যাঁ, বিনয়ের মনে একটা প্রবল অভিমান ছিল এবং এখনো আছে। আর সে অভিমান মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের একাংশের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হলো, তিনি কি তাঁদের বাইরে যেতে পেরেছেন? এখন যাঁরা বিনয়কে অনুকম্পা সহকারে স্মরণ করেন, তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করে নিজেদের অপরাধবোধের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে চান তারাও তো মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদেরই একটা অংশ।’ (ছফা ২০১১: ২০৫)

মানুষ ইতিহাস গড়ে বটে কিন্তু সে ইতিহাস যাচ্ছেতাই হয় না। অতীতের হাত হইতে সরাসরি উত্তরাধিকারস্বরূপ পাওয়া মালমশলা দিয়াই সেই ইতিহাস গড়িতে হয়। কোন এক জার্মান ভদ্রলোকের এই উক্তিতে আহমদ ছফাও আশা করি বড় নারাজ হইতেন না। দুই চারিটি অসামান্য অতিশয়োক্তি সত্ত্বেও আহমদ ছফার এই লেখাটি মনে হয় আমাকেই সম্বোধন করিয়া লেখা। আহমদ ছফা সুযোগ পাইলেই আমাকে বলিতেন, ‘তুমি এতদিন প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গেলা, কোনদিন লেখক হইলা না।’ আমিও আজ নতশিরে বলিব ঠিক কথাই বলিয়াছিলেন তিনি। আহা, আজ আহমদ ছফার এই লেখাটি হাতে না পড়িলে আমার হাতে হয়তো ‘লোক’ পত্রিকা বিষয়ে লেখার কিছুই থাকিত না। 

দোহাই

১। আহমদ ছফা, ‘যৎকিঞ্চিত বিনয় মজুমদার’, আহমদ ছফা রচনাবলি, উত্তর খ-, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা : খান ব্রাদার্স, ২০১১), পৃ. ২০১-২০৫।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //