নতুন পাঠ: উজান স্রোতের সান্তিয়াগো

বিশ শতকের মার্কিন সাহিত্যের অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান আত্মহননের মাধ্যমে। মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে ট্রিগার টিপে।

জানা যায়, তাঁর বাবা এবং ভাইও এমন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কেন তাঁরা এমন পথে জীবনাবসান ঘটান, তা সত্যিই এক রহস্য। হেমিংওয়ে দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক বৈকল্য তৈরি হয়, যার ফলে তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্য ১৯৫৪ সালে সশরীরে সুইডেনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এ জন্য তাঁর মনে অনেক খেদও ছিল।

হেমিংওয়ে বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী ঔপন্যাসিক ছিলেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই ইলিনয়ের ওক পার্কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখকজীবনের শুরু আঠারো বছর বয়সে কানসাস সিটি স্টার পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। ১৯২১ সালে তিনি টরন্টো স্টার উইকলির ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। গ্রিক-তুরস্ক যুদ্ধের সময় ভ্রমণে তিনি ট্রেনে হারিয়ে ফেলেন লেখাভর্তি সুটকেস, একমাত্র বেঁচে যায় ‘মাই ওল্ডম্যান’ গল্পটি।

আবার সবকিছু তাঁকে নতুন করে শুরু করতে হয়। তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত এবং সাড়া জাগানিয়া সব লেখা। ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’র মতো এমন ভাবনার উপন্যাস আর দুনিয়াজুড়ে দ্বিতীয়টি নেই। ১৯২৩ সালে হেমিংওয়ের প্রথম বই ‘থ্রি স্টোরিজ অ্যান্ড টেন পোয়েমস’ প্রকাশিত হয়।

এরপর ‘ইন আওয়ার টাইম’, ‘টরেন্টস অব স্প্রিং’, ‘দি সান অলসো রাইজেস’, ‘মেন উইদাউট উইমেন’, ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’, ‘দি ফাস্ট ফরটিনাইন’, ‘ফর হুম দ্য বেল টোল্স’, ‘অ্যাক্রস দ্য রিভার অ্যান্ড ইনটু দ্য ট্রিজ’ গ্রন্থগুলো প্রকাশ করেন।

আর ১৯৫২ সালে প্রকাশ করেন বুড়ো সান্তিয়াগোর সেই সাহসী গল্প- দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি। বিভিন্ন সময়ে এই উপন্যাস নিয়ে নতুনভাবে কথা বলেছেন, চিন্তার নবদিক আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন সারা পৃথিবীর সমালোচক ও পাঠকরা।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে রচিত ও চিন্ময় পাল সম্পাদিত ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ মানুষের সংগ্রামে টিকে জয়ী হবার এক চমৎকার গল্প। যেখানে লেখক দেখিয়েছেন দৈবপাক, দুর্ঘটনা মানুষকে কাবু করতে পারে, কষ্ট দিতে পারে কিন্তু সংগ্রামী মানুষকে কখনোও পরাজিত করতে পারে না।

মানুষ এক চমৎকার রহস্যের আঁধার। মানুষের শক্তির সীমানা কখনো কখনো তার নিজের চিন্তা ও কল্পনার বাইরে। মানুষ মারা যেতে পারে কিন্তু কখনো পরাজিত হতে পারে না। এই গল্পের প্রধান চরিত্র যে বুড়ো জেলে, বয়সের ভারে আজ সে ন্যুব্জ, কিন্তু তবুও তার দৃঢ় মনোবল, বিশ্বাস তাকে তার সংকল্প হতে কোনোভাবেই বিতাড়িত করতে পারে না।

অন্যের বিদ্রুপ, হাসি তাকে কষ্ট দিলেও পরাস্ত করতে পারে না। দিনমান যে একা বিশাল সমুদ্রে মাছের আশায় বসে থাকে তার ভাষ্যমতে- ‘মানুষের জন্য যন্ত্রণা-ফন্ত্রণা কোনো ব্যাপারই না’।

মানুষ দুর্জয়কে জয় করে একমাত্র তার কঠিন মনোবল দ্বারা, কেননা এই বিশাল পৃথিবীর সৃষ্টির মাঝে মানুষ সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান প্রাণী তেমনি সবচেয়ে দুর্বল। তথাপিও যে দ্বিগবিজয়ী একমাত্র তার দৃঢ় মনোবলের জন্য। মরবার আগে মানুষ সহজে মরতে চায় না। যখন হাঙ্গরগুলো এসে বুড়োর শিকার করা মাছ খুবলে খুবলে খেয়ে নিচ্ছিল তখন যে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাতর হয়ে পড়ছিল ঠিকই, কিন্তু আশা হারায়নি বলেই বলতে পেরেছিল- ‘গেলানো যেটুকু আছে খেয়ে নে, তারপর স্বপ্ন দেখতে থাক তুই একটা মানুষ মেরেছিস।’

এখানে মৃত বা মারা শব্দটা বুড়ো জেলে পরাজিত হবার জন্য ব্যবহার করেনি বরং কিঞ্চিৎ উপহাসের অর্থে ব্যবহার করেছেন যে এরপর হাঙ্গরটা নিজে মরবে। একটা মানুষকে মেরে ফেলা সহজ কিন্তু তার স্বপ্নকে মারা সহজ নয়। কেননা তার স্বপ্নের বীজ তার মাঝ থেকে অন্যের মাঝে বিস্তারিত। যেমন বুড়ো জেলে থেকে তার শিষ্য জেলের মাঝে।

মানুষের আশা অসীম। তার আপনজন তাকে ছাড়লেও আশা কখনো মানুষকে ছাড়ে না, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে, তাবলে ভাবনা করা চলবে না, ও তোর আশলেতা পড়বে ছিঁড়ে, হয়তো রে ফল ফলবে না, তা বলে ভাবনা করা চলবে না।’ তেমনি আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলতে চেয়েছেন যে মানুষ কখনো আশাহত হতে পারে না, এক আশা নিভে গেলে, নতুন ভোরে নতুন আলো নতুন আশা জোগাবেই, অত্যন্ত চমৎকারভাবে তা ফুটে উঠেছে এই গল্পে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //