রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: কষ্টের দহনে পুড়ে যাওয়া কবি

জগতের ভাঙনের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয় ভাঙার যে জোয়ার শুরু হলো, রক্ত ও আগুনের নদী বেয়ে, সামন্তকালের তলোয়ারের যুগ শেষ হয়ে মানুষ যখন বন্দুকের যুগে প্রবেশ করল; তখন পৃথিবীর সমস্ত নৈতিকতা বারুদে পুড়ে গেল। বারুদ হয়ে উঠল মানুষের শক্তিমত্তা প্রকাশের সর্বশেষ অস্ত্র। আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করার বিষয় এই, সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত শিল্পীবৃন্দ তাদের মনোভুবনকে সুকুমার সৌন্দর্যের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করেছেন। সে বুর্জোয়া ভাবাগের শিল্পী হোক, আর মানুষের মুক্তির জন্য হৃদয় ভেঙে কষ্টের দহনে পুড়ে যাওয়া শিল্পীই হোক। তারা মানুষের মুক্তির জন্য জীবনকে নিবেদন করেছেন; কিন্তু প্রশ্ন জাগে তখন, যখন কোনো শিল্পী বুর্জোয়া মুনাফার মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে তার প্রচারে নির্লজ্জভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

শিল্প সম্পর্কে এমিলি জোলা বলেন- ‘আমরা এ পর্যন্ত শুধু বিশ্লেষণ পেয়েছি, সংশ্লেষের জন্য আরও পথ যেতে হবে। মধ্যস্থতা করা বিধায়কের কাজ; এ সম্পর্কে ভাবতে দিন এবং সবকিছু সঠিকতায় স্থাপন করতে দিন। এ নিয়ে আমার করার কিছু নেই। ‘বর্তমান ব্যবস্থার খুঁটিনাটি’ তদন্ত হওয়া উচিত ভবিষ্যৎ বিকাশের দৃষ্টি রেখে। আগামী দিনের শক্তির মধ্যেই সব প্রত্যাশা নিহিত আছে। আর সে শক্তি জনগণের সঙ্গেই রয়েছে।’

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমি দেখি নাই, কিন্তু তাঁকে শুনেছি আর পড়েছি। বাংলাদেশের কেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা সিটির শাহবাগে একজন রুদ্র তার কাব্যজীবনকে পরিব্যাপ্ত করছেন, শানিত করছেন। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-দর্শন-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-সাহিত্য-কবিতা সম্পর্কে নিবিড় অনুশীলনে নিজেকে ঝালাই করে নিচ্ছেন। কেন, তিনি সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে নয়, সবকিছু বুকে ধারণ করে নিজেকে তৈরি করছেন! তার উত্তর আমি শিরোনামেই দিয়েছি। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, হৃদয়ভাঙা ভালোবাসা, অকৃত্রিম, অসহ্য, অনন্ত ভালোবাসা।

পৃথিবীর প্রগতির পথ নির্মাণে বুর্জোয়া অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যে আধুনিকতা নির্মাণ হলো, সে আধুনিকতা কতটা প্রতারণাপূর্ণ, রুদ্র তা ভালো করেই বুঝেছিলেন। তাই, তিনি সে পথে পা মাড়াননি; কিন্তু পৃথিবীর অন্য কবিরা বুঝে না বুঝে সে অবক্ষয়ের আধুনিকতায় পা বাড়িয়েছেন; সেটা আমরা বদলেয়ার থেকে শুরু করে আমাদের দেশের আধুনিক নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের মধ্যেও দেখতে পেয়েছি। এ ভুল অনেকে করেছেন। ফলে, দর্শনের জায়গায়, বোধের জায়গায় কবিতা কতটা কাঁচা রয়ে গেছে, সেটা রুদ্র বুঝেছিলেন।

সেটা বাংলা ভাষার কবিতার ক্ষেত্রে যেমন সত্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কবিতার ক্ষেত্রেও সমান সত্য। কেউ কেউ সেই সত্য ডুবিয়ে দিয়ে মানুষের সত্য নির্মাণ করেছেন। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পৃথিবীর সেই সেই বিরল কবিদেরই একজন, যার নাম একবাক্যে পৃথিবীর গ্রেট কবিদের সঙ্গে নিতে হয়। 

এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে বাংলা কবিতার সত্তর দশকে একজন রুদ্রই পরিব্যাপ্ত হয়েছেন সমহিমায়, প্রতিভায়, ভালোবাসায়, দহনে, ক্ষরণে, আগুনে, নির্নিমেষ বেদনায়। প্রত্যাশার বেদনা বয়ে বেড়ানো কি যে কষ্ট রুদ্রের কবিতা আমাদের তা উপলব্ধি করতে শেখায়। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলার সেই সাহসী যুবক যার শিল্পচেতনা প্রাচীন বাংলার শিল্পী ভাস্করদের নব নব সৃষ্টির দিকে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যে ভাস্কর্য শিল্পীরা সামন্ত জমিদার ও রাজাদের কথা অমান্য করে নিজেদের দর্শনজাত ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন। 

বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সেই ভাস্কর্যগুলো দেখলে আমরা শিল্পীর স্বাধীন সেই ইচ্ছে শক্তিকে দেখতে পাই। আমাদের শিল্প সমালোচক, ফোকলোরবিদরা বাংলার মানুষের স্বকীয় শক্তিমত্তার এই বিষয়টি ধরতে পারে নাই। ধরতে না পারার কারণও আছে আমাদের সব শিল্প সমালোচক, কবিতা লিখিয়ে, সাহিত্য করা মানুষ জীবনের অতলে ডুব দিয়ে জীবনকে দেখার সাধনা করতে চাইনি। উপরিভাবে সব কিছুকে হালকা করে ফেলেছে আর আধুনিকতা আমাদের এমন কিছু সহজ শব্দ উপহার দিয়েছে যাতে আমরা ভাবনাটাই সেই আধুনিকদের মতো করে ভাবি। ফলে নিজেদের সৃষ্টি সম্পদের দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি নাই।

এ না পারা আমাদের মৌলিক আধুনিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উদারনৈতিক আধুনিকতায় আমাদের অর্জন অনেক কিন্তু মানুষের চিরন্তন ও মৌলিক আধুনিকতা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। বিশিষ্ট ইংরেজ সাহিত্য সমালোচক জে আইজ্যাকস বলেন, ‘আধুনিকতা কী? কি আসলে? এই প্রশ্নটির জবাব এবং ভাবি কাল আমাদের কালের বিশিষ্ট উপাদান সম্পর্কে কি বলবে, তা জানলে আমরা নবী হয়ে যেতাম। আমার প্রশ্নের পরিধি অবশ্যই অনেক কম। আমাদের কালের বিশেষ সুরটি কি যাকে আমরা চিনি, কবিতায় পেলে স্বতঃস্ফূর্তই ভালোবাসি কিংবা ঘৃণা করি? আধুনিক কবিতার বিশেষ গুণটি কী? সে কি দুর্বোধ্যতা, ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ বা শ্রুতিকটু ধ্বনি? সে কি চিরন্তনের পরিবর্তে সাময়িক, সাধারণে পরিবর্তে বিশেষ? সমস্যা নিতান্ত সরল নয়। এখানে নানা পরস্পরবিরোধী বিষয়ের অবকাশ রয়েছে।

একদিকে বিশুদ্ধ কবিতা, অন্যদিকে অশুদ্ধ কবিতা, অর্থাৎ সামাজিক এবং রাজনৈতিক কবিতা। আধুনিক কবিতার বুনন অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কাঠামোর দিক থেকে তা উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বের ভারসাম্য রক্ষা করছে। মন্দের দিক থেকে তা অসংগঠিত ও অসংলগ্ন সব খ-াংশের একটা গুচ্ছ বিশেষ। আর ভালোর দিক থেকে তা একটি বহুবর্ণ গম্বুজ যেখানে রঞ্জিত হচ্ছে অনন্তের শে^তপ্রভা’ (আধুনিক কবিতার পটভূমি- হুমায়ুন কবির অনূদিত, মূল : জে আইজ্যাকস, প্রকাশক : দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৪)। 

জে আইজ্যাকসের আধুনিকতা নিয়ে এই যে প্রশ্ন, তা ভেঙে দিয়েছেন পৃথিবীর অনেক কবি এবং তারা আধুনিকতাকে নতুন করে নির্মাণ করেছেন। পো থেকে শুরু করে লোরকা, দেরিদা, চেশোয়াভ মিউশ, এমে সেজায়াসহ পৃথিবীর অসংখ্য কবি। সেই মৌলিক অসংখ্য কবিদের একজন আমাদের রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। 

বাঙালি সভ্যতা ছিল পালা পার্বণে যাত্রায় উৎসবে মেলায় উৎসর্গকৃত এক কৌম সমাজ। শিল্পে সমুন্নত, নারীদের নৃত্য ও গানের মাধবী ছিল সামন্ত দেবতাদের ভোগের বস্তু। যেভাবে হোক নারীদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হতো, তা না হলে তারা মন্দির কুমারী হতে পারত না বা সমাজের কেউকেটাদের কাছে তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ত। শস্য ফলানো, ধান রোপণ, কুমোর শিল্প, ভাস্কর্য, নৌকা তৈরি, নদী ও সাগরে মাছ ধরা, বন্য পশু শিকার ইত্যাকার কত কত কাজের ভেতর দিয়ে সমাজ বিন্যস্ত হয়েছিল।

সেই প্রগতিশীল সমাজে ধাক্কা লাগল অনেক। নিজস্ব ভাবনা দিয়ে পরিব্যাপ্ত হওয়ার পূর্বে রক্ত ও অগুনের নদীতে ডুবতে হলো তাদের। বাহামিয়া, মোঘল, পাঠান, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এসে সব তছনছ করে দিল। এই তছনছের ও ভাঙচুরের রক্তাক্ত ক্ষতের মধ্য দিয়ে যে সমাজ নির্মাণ হলো সেই আধুনিক সমাজের যাত্রা বিন্দুর শুরুতেই রুদ্ররা জীবনকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন শিল্পে- মানুষের মুক্তির জন্য। রুদ্র তার কবিতার পঙ্্ক্তিতে পঙ্্ক্তিতে এই বাংলাদেশকে চিত্রায়িত করলেন। রুদ্রর কবিতা পড়লে বাংলাদেশকে, পৃথিবীকে নতুন করে অনুভব করা যায়। মনে হয় কত আপন এই দেশ, এই পৃথিবী কত চেনা। তার ভাষা, রঙ, রূপ, রেখা, স্বাদ, গীতল সুর আমাদের মনকে সঞ্চালিত করে এক নব প্রেরণায়। একটি ঝড়ঝঞ্ঝাময় বাংলাদেশ, ষড়ঋতুর বাংলাদেশ, শোষণের বিরুদ্ধে জর্জরিত তবে লড়াইরত বাংলাদেশকে আমরা নতুন করে জেগে উঠতে দেখি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //