বাংলার গৌরব সাহিত্যবিশারদ শেখ ফজলল করিম

বাঙালি মুসলমানের হারিয়ে যাওয়া গৌরব- ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে বাংলা ভাষাভাষী যে কয়জন মুসলিম সাহিত্যিক-কবি তাঁদের কীর্তি দ্বারা অমর হয়ে রয়েছেন, তাদের মধ্যে কবি শেখ ফজলল করিম অন্যতম। ইসলামী ভাবচিন্তার মানস গঠনে শেখ ফজলল করিম তৎকালীন সময়ে ছিলেন একজন অগ্রজ কবি। তিনি লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় ১৮৮২ সালের ৯ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন । শৈশবে কাকিনা স্কুল থেকে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ ফজলল করিম মধ্য ইংরেজি পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। রংপুর জিলা স্কুল থেকে মাইনর পরীক্ষায় পাস করেন। ছাত্রাবস্থায় কাকিনা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বিয়ে হয় কালীগঞ্জ উপজেলার বিন বিনিয়া গ্রামে- এরপর পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণে তার শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কবি শেখ ফজলল করিম ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একটি পাটের কোম্পানিতে চাকরি করেন। স্বাধীনচেতা ফজলল করিম কোম্পানির মন জুগিয়ে কাজ করতে না পারায় স্বীয় চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন। ত্রিশের দশকে শেখ ফজলল করিম ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মুন্সি মেহেরউল্লাহর (১৮৬১-১৯০৭ খ্রি.) অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ পেয়েছিলেন। কবি তার সাহিত্য সৃষ্টি, প্রকাশনা ও সাধনার পথে ধাবমান ছিলেন এই কারণে- কাকিনায় নিজবাড়িতে তার পীর সাহেব হজরত মওলানা মহম্মদ শাহ সাহাব উদ্দীনের নামানুসারে তৎকালীন প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস’। 

তিনি শেষজীবন পর্যন্ত লেখার জগত নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। তার সাহিত্যিকজীবনের উন্মেষ ঘটে বালক বেলায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি ‘সরল পদ বিকাশ’ কবিতাগুচ্ছ রচনা করেন। এরপর থেকে তিনি আমৃত্যু সাহিত্য রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তার সাহিত্যকর্মের প্রধান বিষয় ছিল নীতিশাস্ত্র ও ধর্ম। নৈতিক আদর্শে সমৃদ্ধ কবিতা ও গদ্য লিখে কবি শেখ ফজলল করিম সে সময়ে মুসলিম পাঠক সমাজে সুনাম অর্জন করেন। মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম উপাখ্যান, মুসলিম জীবন ইত্যাদি ছিল তার সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়, ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘আহমেদিয়া লাইব্রেরি’ নামক একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম তার কখনোই ভালো লাগত না। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে বরং তিনি অন্যান্য জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী ছিলেন, বিশেষ করে ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থের প্রতি আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। বালক করিম জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, একইসঙ্গে কঠোর অনুশীলনের কারণে তার লেখার জগতকে সমৃদ্ধ করেছে অধিক। শেখ ফজলল করিমের সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য বিষয় ধর্মীয় হলেও দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা ও সাহিত্যিক প্রসাদগুণে তার সৃষ্টি সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামির ভেতর কখনো তিনি নিজেকে নিমজ্জিত রাখেননি, জ্ঞানচর্চার নিবিড়তা তার প্রতিটি রচনায় তাই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

শেখ ফজলল করিমের পরিচিতি মূলত একজন কবি হিসেবে কিন্তু আমরা দেখি তিনি কবিতা ও কাব্য ছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনী গ্রন্থ, ইতিহাস গবেষণামূলক নিবন্ধ, সমাজ সচেতনতামূলক তত্ত্বকথা, গল্প, শিশুতোষ রচনা, নীতিকথা এবং বিবিধ সমালোচনামূলক রচনা। সাহিত্যের সব শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। তিনি অসংখ্য পত্রপত্রিকায় লিখতেন- নবনূর, কোহিনূর, বাসনা, মিহির ও সুধাকর, ভারতবর্ষ, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শিশুসাথী, কল্পতরু, মোসলেম ভারত, সোলতান, মাসিক মোহাম্মদী প্রভৃতি। 

সমকালীন মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে যে নবতর সাহিত্য প্রচেষ্টার উন্মেষ এ দেশে ঘটেছিল, তার সার্থক ধারক ও বাহক ছিলেন শেখ ফজলল করিম, সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তার রচিত- ‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্যপদক লাভ করেন। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করে। এ ছাড়াও তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পান- ‘কাব্যভূষণ’, ‘সাহিত্যরত্ন’, ‘বিদ্যবিনোদন’, ‘কাব্যরত্নকর’ সম্মান উপাধী। শেখ ফজলল করিম নিজ গ্রাম থেকে ‘বাসনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে। ‘বাসনা’ পত্রিকাটি দুই বছর চলেছিল। ‘সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান মিলন সম্ভব’ এটিতে তিনি মত দিয়েছিলেন। সেই সময়ে ‘বাসনা’ পত্রিকায় হামেদ আলী, শেখ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, তসলিম উদ্দীন আহমদ (রংপুরের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট) এ ছাড়া অনেক স্বনামখ্যাত ব্যক্তির লেখা প্রকাশিত হতো।

সেই সময়ে ‘বাসনা’ পত্রিকাটি ছিল পূর্ববঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা। ফলে পত্রিকাটির পাঠকসংখ্যাও যথেষ্ট বেশিই ছিল, যারা সে সময়ে পূর্ববঙ্গে লেখালেখি করতেন এবং জ্ঞানচর্চার সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন তারা সবাই এই বাসনা পত্রিকার পাঠক ছিলেন। বলা হয়ে থাকে- শেখ ফজলল করিম যেমন নিজে লিখেছেন দু-হাতে তেমনি করে নিজের প্রকাশিত পত্রিকা ‘বাসনা’র মাধ্যমে অসংখ্য লেখকের লেখা মানুষের পাঠের সুযোগ করে দিয়েছেন, ফলে তিনি যেমন নিবিষ্টভাবে সাহিত্যেপ্রেমী একজন মানুষ তেমনি ছিলেন গুণী লেখক এবং একজন দায়িত্বশীল সম্পাদকও বটে। শেখ সাহেবের গ্রামের বাড়িতে তার রেখে যাওয়া সেই ‘আহম্মদীয়া লাইব্রেরি’টি আজ অর্থাভাবে ব্যবস্থপনার অভাবে যেন শেষ চিহ্নটুকু বুকে করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার স্মৃতিবিজড়িত গ্রামের এই বাড়িটিও যেন ধ্বংস হতেই কেবল বাকি। 

বিভিন্ন সূত্রমতে, অবহেলিত আজ এই কবির স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার কোনো তাগিদ নেই দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। পৃথিবীর অন্যকোনো দেশে জন্ম নিলে কবি শেখ ফজলল করিম হয়তো এতটা অবহেলায় থাকতেন না মৃত্যুর ৮১ বছরে এসেও। বরং তার বাড়ি ঘিরে গড়ে উঠত একটি গবেষণা বিভাগ কিংবা একটি জাদুঘর, যার নাম হতে পারত- কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি জাদুঘর।

কবি ফজলল করিমের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা অনুযায়ী আনুমানিক মোট ৫৮টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়।  এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সরল পদ্য বিকাশ (বাল্যকালের রচনা), তৃষ্ণা (কাব্য), মানসিংহ, পরিত্রাণ, (কাব্য), ভগ্নবীণা বা ইসলাম চিত্র, লাইলি-মজনু, আফগান স্থানের ইতিহাস, ভক্তি পুষ্পাঞ্জলি, গাঁথ, হারুন-অর-রশীদের গল্প, বিবি রহিমা, পথ ও পাথেয়, রাজর্ষি এবরাহিম, চিন্তার চাষ, বিবি খাদিজা, বিবি ফাতেমা, মোহাম্মদ চরিত, বিবি আয়েশা, ছামিতত্ত্ব বা ধর্মসংগীত ইত্যাদি। তিনি ওমর খৈয়ামেরও বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।

 শেখ ফজলল করিমের গদ্য রচনা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ভাষা নির্মাণে তার অসাধারণ দক্ষতা। তিনি বৈচিত্র্যময় রচনার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন যেমন, ঠিক তেমনি তিনি গভীর দর্শন নিয়েও ভেবেছেন। মানুষের প্রতি উদারমনষ্কতা সম্পন্ন একজন লেখক ছিলেন তিনি। তার রচনায় সমসাময়িক ঘটনা, চিন্তা-চেতনা, ধর্ম-দর্শন, সাম্প্রদায়িক বিরোধ, সমাজ-সংস্কার, নারী শিক্ষা সমাজ পরিবর্তন ও মননশীলতার অঙ্গীকার লক্ষণীয়।

তার সাহিত্য সৃষ্টিতে ছিল নিজস্বতা, নিজস্ব সুর- স্বর, নিজস্ব ভাষা। আবেগ উপলব্ধি ও অনুভূতি প্রকাশের সে ভাষাকে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করেছেন। সরল ও ছন্দময় গতিময়তা তার লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর,/মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরা সুর- ‘স্বর্গ ও নরক’ নামক কালজয়ী এই কবিতাটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির এই কবিতাটি বাংলাদেশের শিশুদের মুখে নয় কেবল সমান জনপ্রিয় বড়দের কাছেও। বাংলাভাষার আদর্শ এই অমর কবি ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি আমাদের শিশুদের প্রেরণা হয়ে থাকতে পারেন- ক্ষয়িষ্ণু সময়ের হতে পারেন একটি নক্ষত্র ও পথপ্রদর্শক। যেখানে রয়েছে- সুচিন্তা ও সুচিন্তিত সমাজ গঠনের একটি নতুন আহ্বান।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //