মঞ্চ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ

হাজার বছরের নাট্যচর্চার ইতিহাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার সূচনা হয়, যা আজ দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও আস্থাশীল শিল্প মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যদিও ’৭৫-পরবর্তী বিভিন্ন সময় প্রায় সব মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি তাদের কালো থাবা বসিয়েছে। সেখানে মঞ্চনাট্যকর্মীরা সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বুকে ধারণ করেই পথ চলেছেন।

এটি আমাদের নাট্যচর্চার বড় শক্তি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র ঘটনাবলিকে তখন নানা কাহিনি বা দৃশ্যকাব্যে তুলে ধরাটা দেশের লেখকদের জন্য নৈতিক দায়িত্ব হয়ে ওঠে। সেই দায় থেকেই বিভিন্ন নাটক, গল্প, উপন্যাস তথা সাহিত্য-সৃজনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেক্ষাগৃহ, মঞ্চ ও টেলিভিশনে উপস্থাপিত হয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও নাটক। বাংলা সাহিত্যে নাটকের স্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, জাতির যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সব সময় নাটককে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সচেতনতা-সংগ্রামে মঞ্চনাটক হয়ে উঠেছে সমাজ বা রাষ্ট্র বদলের হাতিয়ার।

এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং চেতনা নতুন প্রজন্মের ভেতরে ছড়িয়ে দিতে নাটকের অবদান ও আবেদন অনেক। দেশীয় প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি স্বাধীনতার আগে ও পরে আমাদের নাট্যকাররা বিদেশি বহু বিপ্লবী নাটক অনুবাদ ও রূপান্তরের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ঢাকাসহ সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে অনেক নাটকই রচিত হয়েছে। তবে সব নাটকই যে শিল্প-উত্তীর্ণ তা বলা যায় না। আবার কিছু নাটক অসাধারণ শিল্পমান বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অর্ধশতাধিক নাটক রচিত হয়েছে।

এসব নাটকে স্থান পেয়েছে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানিদের হাতে নারী ধর্ষণ, ধর্ষিত ও নির্যাতিতদের আর্তনাদ, বাঙালির অকুতোভয় অবিরাম পথচলা আর বীরত্বগাথা বিজয় এমনকি রাজাকার, আলবদর, আলশামস তথা পাকিস্তানি নরপশুদের অমানবিক নিষ্ঠুরতার লোমহর্ষক নানা চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত মৌলিক নাটকের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিপ্লব-বিদ্রোহের গল্প-উপন্যাস অবলম্বনেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক নাটক রচিত হয়েছে। যার মধ্যে অনেক নাটকই মঞ্চে এসেছে।আবার অধিকাংশই মঞ্চে আলোর মুখ দেখেনি।

মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে সবচেয়ে মঞ্চ সফল ও আলোচিত নাটক লিখেছেন  সৈয়দ শামসুল হক। তার কাব্যনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ তখন সর্বমহলে আলোচনার ঝড় তোলে। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ ও ‘এখানে এখন’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক ও বিষয়াবলি নিয়ে যেসব নাট্যকার নাটক লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- সাঈদ আহমেদ, আল মনসুর, রণেশ দাসগুপ্ত, পংকজ বিভাস, এসএম সোলায়মান, জিয়া হায়দার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, নিলীমা ইব্রাহীম, নুরুল আম্বিয়া, কল্যাণ মিত্র প্রমুখ।

এসব নাট্যকার তাদের নাটকে যেভাবে বর্ণিল শিল্পরসে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র, অনুষঙ্গ বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ অঙ্কন করেছেন তা আজ কালের সাক্ষী। পরে প্রয়াত নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মান্নান হীরা, মামুনুর রশীদ, ড. ইনামুল হক মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অনেক নাটক লিখেছেন। ফাল্গুনী হামিদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কুমার প্রীতিশ বলের বেশকিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকও বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে যোগ করেছে দেশপ্রেমের একটি স্বাতন্ত্র্য মাত্রা।

একইভাবে মঞ্চের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে বহু পথনাটকও। অবশ্য, ব্যাপক অর্থে প্রথমদিকে পথনাটক ও বেশ কিছু মঞ্চনাটক জাতিকে দেশাত্মবোধের চেতনা যেভাবে আন্দোলিত করেছে, পরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যপ্রয়াস সেভাবে আশানুরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রতিবাদী নাটকের ক্ষেত্রে সম্প্রতি জহির রায়হানের ছোটগল্প অবলম্বনে নাটক ‘সময়ের প্রয়োজনে’, মান্নান হীরা রচিত ‘লালজমিন’, মামুনুর রশিদের ‘টার্গেট প্লাটুন’, বাবুল বিশ্বাসের ‘পোড়ামাটি’ নাট্যাঙ্গনে বেশ আলোচিত হয়েছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন নাটকে নানাভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশাত্মবোধের অপার চেতনা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে থিয়েটার অঙ্গনে যে নাটকগুলো নির্মিত হয়েছে তার সবই কি শিল্পসম্মত হয়ে উঠেছে? সব নাটকই কি দর্শক তথা নতুন প্রজন্মের অনুভূতিকে ছুঁতে পেরেছে? সে প্রশ্নটি থেকেই যায়। তবে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা দেশাত্মবোধের চেতনালব্ধ নতুন-পুরনো অনেক মঞ্চনাটক বরাবরই আমাদের দর্শকদের বোধের জগৎকে জাগ্রত করে তোলে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //